বরিশাল: ‘অতি লোভে, তাঁতি নষ্ট’ এ প্রবাদ
বাক্যটির আবারও প্রমাণ মিললো বাস্তবে।
তবে এবার খেসারত
হিসেবে বলি দিতে হয়েছে ১৬টি তাজা প্রাণ।
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় সম্প্রতি লঞ্চ
ডুবিতে প্রাণহানির ঘটনায় এমন তথ্য
উঠে এসেছে। এছাড়াও তদন্ত কমিটির
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে লঞ্চটির অবকাঠামোগত
ত্রুটির বিষয়টি।
অনুমোদিত নকশার সঙ্গেও রয়েছে নৌযানটির
প্রকৃত অবস্থার ব্যাপক অমিল। এ ঘটনায়
দায়ী করে এমভি শাতিলের ফিটনেস
প্রদানকারী কর্মকর্তা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের
(ডস) বরিশাল অফিসের প্রকৌশলী ও জাহাজ
জরিপকারক মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকারকে প্রধান
কার্যালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি)
করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এম
ভি শাতিল-১ লঞ্চটিতে ৮শ’ কেজি মাছ ছিলো। দুই
লাখ টাকা দামের মাছগুলো পটুয়াখালী লঞ্চ
ঘাটে বিকেল সাড়ে ৫টার মধ্যে পৌঁছতে হবে।
কারণ
মাছগুলো পটুয়াখালি থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চে রাজধানীতে পাঠানো হবে।
এ কারণে যাত্রীদের অনুরোধ
উপেক্ষা করে বৈরি আবহাওয়ায় মারাত্মক
ঝুঁকি নিয়ে ইছাদি ঘাট ত্যাগ করে লঞ্চটি।
এতেই ঘটে বিপদ। কালবৈশাখীর ঝড় হাওয়ায়
ডুবে যায় এম ভি শাতিল-১ লঞ্চটি। ত্রিশ যাত্রীর
মধ্যে নিহত হন ১৬জন। এখনো নিখোঁজ ১০জন।
কিন্তু এ তথ্য উঠে আসেনি তদন্ত কমিটির
প্রতিবেদনে। তবে এটি কি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ
নৌ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিটিএর) দায় এড়ানোর
কৌশল? এ নিয়ে রয়েছে স্বজনহারা মানুষের
নানা প্রশ্ন।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে লঞ্চটি এর আগে গত ২৭
জানুয়ারি পটুয়াখালী-গলাচিপা রুটে দুর্ঘটনার
কবলে পড়ে। এ ঘটনায় সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর এক
পত্রাদেশে লঞ্চের চলাচল বন্ধ করে দেয়।
এরপর বরিশাল অফিস পত্রমারফত
অধিদফতরকে জানায়, নৌযানটি চলাচলের সম্পূর্ণ
উপযোগী। একই পত্রে নৌযানটিকে চলাচলের
অনুমতি প্রদানের সুপারিশ করা হয়। পরে পুনরায়
লঞ্চটি ওই নৌ রুটে চলাচলের অনুমোতি পায়।
বিনিময়ে বরিশালে কর্মরত কর্মকর্তাদের
পটুয়াখালির লঞ্চ মালিক শাহজাহান খান
মোটা অংকের উৎকোচ দেন।
ফলে লঞ্চটি’র অবকাঠামোগত ত্রুটিগুলো থাকে ধরা-
ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু প্রাণহানির পরে লঞ্চটি’র
ত্রুটিগুলো অনুসন্ধানে নামে তদন্ত কমিটি।
তদন্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার
শর্তে বলেন, ‘তদন্তে লঞ্চটির বেশ
কয়েকটি ত্রুটি ধরা পড়েছে। যেমন অনুমোদন
অনুযায়ী লঞ্চটির গভীরতা হওয়ার
কথা ছিলো ১দশমিক ৬৮শতাংশ। কিন্তু
সেখানে দেয়া হয়েছে ১দশমিক ৪৯শতাংশ। ২৬৫
অশ্বশক্তির ইঞ্জিনের পরিবর্তে ব্যবহার
করা হয়েছে ১৮০ হিনো ইঞ্জিন।’
তিনি বলেন, ‘ধারণ ক্ষমতার চেয়ে যাত্রীদের জন্য
দ্বিগুন পরিমাণে (আপার) স্পেস রাখা হয়।
পাশাপাশি নৌযানটির মাস্টার (চালক)
এবং ড্রাইভার ছিলেন অদক্ষ।’
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
বার্ষিক সার্ভে (ফিটনেস) এবং চালকদের
মাস্টারশিপ সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট
কর্মকর্তারা দায়িত্বশীল ও সতর্ক হলে এ ধরনের
দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি অনেকাংশেই এড়ানো সম্ভব।
পরিবেশ ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক
সংগঠনগুলোর অভিযোগ, অনিয়ম ও দুর্নীতির
কারণে ত্রুটিপূর্ণ নৌযানের ফিটনেস এবং অদক্ষ
ব্যক্তিদের মাস্টারশিপ সনদ দেয়ার কারণেই
নৌপথে দুর্ঘটনায় প্রাণ ও সম্পদহানি ঘটছে।
উল্লেখ্য, ৩ মে পটুয়াখালীর গলাচিপায় রামদাবাদ
নদীতে নিমজ্জিত হয় এমভি শাতিল-১। কারণ
অনুসন্ধানে গঠন করা হয় জরীপকারক (নিরীক্ষা)
পরিচালক মো. আবুল কাশেমকে প্রধান করে চার
সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি। দুর্ঘটনার দৃশ্যমান
কারণ আকস্মিক কালবৈশাখী ধরা পড়ে কমিটির
অনুসন্ধানে।
বেঁচে যাওয়া অনেক যাত্রীর অভিযোগ, মাস্টার
সতর্ক হলে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। যাত্রীদের
অনুরোধ উপেক্ষা করেই মাস্টার ঝড়ের মধ্যেই লঞ্চ
চালিয়েছেন। এছাড়া সামান্য ঝড়ের কবলে পড়েই
অল্প সময়ের মধ্যে লঞ্চটি পানিতে তলিয়ে যায়
বলে স্থানীয়, প্রত্যক্ষদর্শী ওই লঞ্চের
যাত্রীরা জানান।
অভিযোগ রয়েছে, ৩ মে দুর্ঘটনাকবলিত চালকদের
অদক্ষতা ও গোয়ার্তুমির কারণেই লঞ্চটি নিমজ্জিত
হয়ে প্রাণহানি ঘটে। আকাশে ঝড়ের পূর্বাভাস
লক্ষ্য করেও
নিকটবর্তী তীরে না ভিড়ে মাঝনদী দিয়ে চালিয়ে গেছেন
মাস্টাররা।
জল পরিবেশ বিশেজ্ঞরা বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির
কারণে ত্রুটিপূর্ণ নৌযানের ফিটনেস এবং অদক্ষ
ব্যক্তিদের মাস্টারশিপ সনদ দেয়ার কারণেই
নৌপথে দুর্ঘটনায় প্রাণ ও সম্পদহানি ঘটছে।
ফিটনেস এবং চালকদের মাস্টারশিপ সনদ প্রদানের
ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দায়িত্বশীল ও
সতর্ক হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ও ব্যাপক
প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব।
Posted via Blogaway
No comments:
Post a Comment