Headlines



gazitv2

w41j

gazitv

Wednesday, May 28, 2014

সুকান্ত ভট্টাচার্য্য : প্রচলের বিপরীত কণ্ঠস্বর

সৈয়দা কানিজ সুলতানা
মানবসমাজে রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিবর্তন অনবরত ঘটে,
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে, কিন্তু
সঙ্গে সঙ্গেই শিল্পক্ষেত্রে কোনো বৃহৎ পরিবর্তন
আসে না। উপস্থিতকালে জীবিত বুদ্ধিজীবীরা সবাই ভাবেন যে,
রাজনীতির পরিবর্তন মানুষের চিন্তার রাজ্যেও বিরাট
পরিবর্তনের সূচনা করে। পরিবর্তন হয়তো আসে কিন্তু
সঙ্গে সঙ্গে আসে না। কবিতা,
চিত্রকলা এবং সঙ্গীতে যে পরীক্ষা চলে সে পরীক্ষাগুলো অনেক
দূর পর্যন্ত প্রসারিত থাকে। যদিও
যুক্তিতে বলে যে সমাজের সঙ্গে একটি নিগূঢ় সম্পর্ক
আছে এবং সমাজে উৎসব অথবা অবক্ষয়ের সঙ্গে শিল্প-
চেতনা নিগূঢ়ভাবে সম্পর্কিত, কিন্তু তা সত্ত্বেও
আমরা লক্ষ্য করি, শিল্পক্ষেত্রের পরিবর্তনটি সমাজের
বিবর্তনের সঙ্গে কালের দিক থেকে নিকটবর্তী নয়।
সমাজের সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ককে স্পষ্ট
কোনো নিয়মে বেঁধে দেওয়া যায় না। –এই বাস্তবতার
আলোকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য এক বিস্ময়-বালক,
তিনি তার কবিতা-সাম্রাজ্যে মানবের মুক্তির অনিবার্যতার
খাতিরে পঙ্ক্তি বুনে গেছেন— যা খুব বেশী প্রয়োজনীয়
হয়ে উঠেছিল। সুকান্তের কবিতা বাংলার
কাব্যক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সুকান্তের
কবিতা ছন্দে, শব্দের অনুষঙ্গে একটি নতুন পথযাত্রার
সূত্রপাতও।
অনেক সময় দেখি কবি’র ব্যক্তিগত জীবন তাঁর
কবিতাকে প্রভাবিত করেছে অথবা কর্ম-সম্পাদনা বা জীবন
সম্পর্কে তাঁর জিজ্ঞাসার পরিচয় তাঁর কবিতায় সুস্পষ্ট
হয়েছে। এভাবে অনেক কবি তাদের ব্যক্তিগত জীবনের
বিশ্বাস এবং রাজনীতি কবিতার সাহায্যে প্রতিপন্ন
করতে চেয়েছেন। হ্যাঁ, এই ধারারই একজন বিশিষ্ট
কবি সুকান্ত।
ইংরেজীতে একটি শব্দ আছে Revolutionist, যার প্রচলিত
অর্থ বিপ্লবপন্থী। কবি সুকান্ত কাব্য সাধনায় বিক্ষুব্ধ
চৈতন্যের কারণেই বিপ্লবপন্থী বা বিপ্লবধর্মী। রাজনৈতিক
ও সামাজিক অবস্থার উল্লেখ তাঁর বিভিন্ন কবিতার
মধ্যে আছে। সুকান্তের বিদ্রোহ হল প্রচলিত অবস্থার
বিরুদ্ধে অর্থাৎ তিনি প্রচলিত ব্যবস্থাকে চূর্ণবিচূর্ণ
করতে চান— তিনি দৃঢ়মূল কোনো চিরাচরিত
প্রথা মেনে নিতে চান না। এ কারণে তিনি লেখেন ‘লেনিন’,
‘একটি মোরগের আত্মকাহিনী’সহ এই জাতীয় কবিতা।
ফলে তার সাহিত্য কলায় জারিত হয়ে আছে বিপ্লবের
আয়োজন।
এই কবি’র রচনার সংখ্যা খুব একটা বেশী নয়। কিন্তু
যদি তাঁর বয়সটির কথা মনে রাখি, তবে সেই
সংখ্যা অবিশ্বাস্য। সুকান্তকে আমরা কবি হিসেবেই জানি।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন কেবল মাত্র কবি ছিলেন না,
সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ।
তেমনি সুকান্তও ঐ বয়সেই লিখেছিলেন কবিতা ছাড়াও, গান,
গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ। তাঁর ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’
প্রবন্ধটি পাঠেই বেশ বোঝা যায় ঐ বয়সেই
তিনি বাংলা ছন্দের প্রায়োগিক দিকটিই শুধু
আয়ত্বে আনেননি, সে নিয়ে তাত্ত্বিক দক্ষতাও অর্জন
করেছিলেন। সেই আট ৯ বছর বয়স থেকেই সুকান্ত
লিখতে শুরু করেন। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়’-এ
একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তার
দিনকতক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম
ছাপার মুখ দেখে তাঁর লেখা বিবেকান্দের জীবনী। মাত্র এগার
বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেন
তিনি। কেকল তাই নয়, পাঠশালাতে পড়বার-কালেই ‘ধ্রুব’
নাটিকার নাম ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত। সপ্তম
শ্রেণীতে পড়েন যখন তখন বাল্যবন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর
সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’
সম্পাদনা করেন। অরুণাচল তাঁর আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন।
সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘দৈনিক স্বাধীনতা’র
(১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন।
মার্ক্সবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত
কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। তাঁর
রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল: ছাড়পত্র
(১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান
(১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ
(১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত
সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলী প্রকাশিত হয়। সুকান্ত
ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘের
পক্ষে ‘আকাল’ (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ
সম্পাদনা করেন।
সুকান্ত তার অগ্নিদীপ্ত সৃষ্টি প্রণোদনা দিয়ে সব ধরনের
প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী ছিলেন। বালক
বয়সে তিনি ভাবনার বৈতরণীতে অনেক বেশী অগ্রসর
হয়েছিলেন। সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও লৈখিক
দক্ষতায় অনন্য। সাধারণ বস্তুকেও সুকান্ত কবিতার বিষয়
করেছেন। বাড়ির রেলিং ভাঙ্গা সিঁড়ি উঠে এসেছে তার
কবিতায়। কান্ত তার বয়সের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম
করেছেন তার পরিণত ভাবনায়। কবিতায় কী বলিষ্ঠ কথকতা—
“যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুমঃ
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের—
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস॥”
[‘ছাড়পত্র’]
সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয়
করতে শেখায়। সুকান্ত ভট্টাচার্য অগ্নিময় এক কবিপুরুষ।
তার কবিতার ভূবন বিদ্রোহের আগুনে ঝলসানো। মানুষের
মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত।
সুকান্ত ছিলেন উচ্চতর মানবিক বোধে আক্রান্ত কবি।
তিনি তার অগ্নিদীপ্ত সৃষ্টি প্রণোদনা দিয়ে সব ধরনের
প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী ছিলেন। বালক
বয়সে তিনি ভাবনার বৈতরণীতে অনেক বেশী অগ্রসর
হয়েছিলেন।
সুকান্তকে বলা হয় গণমানুষের কবি। অসহায়-নিপীড়িত
সর্বহারা মানুষের সুখ, দুঃখ তার কবিতার প্রধান বিষয়।
অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন
অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্তও ছিলেন
সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে সুকান্তের ছিল
দৃঢ় অবস্থান। তিনি তার কবিতার নিপুণ-কর্মে দূর
করতে চেয়েছেন শ্রেণী বৈষম্য। মানবতার জয়ের জন্য
তিনি লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অসুস্থতা অর্থাভাব
তাঁকে কখনো দমিয়ে দেয়নি। মানুষের কল্যাণের জন্য সুকান্ত
নিরন্তর নিবেদিত থেকেছেন। তিনি মানবিক চেতনায়
উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন।
“বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?
এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি,
আমরা সবাই যে যার প্রহরী
উঠুক ডাক।
উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে
জ্বলুক আগুন গরিবের হাড়ে
কোটি করাঘাত পৌঁছোক দ্বারে
ভীরুরা থাক।
মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি,
চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি
রুখবে কে আর এ অগ্রগতি,
সাধ্য কার?”
সুকান্ত তার কবিতার মাধ্যমে মেহনতী মানুষের কাছে যুদ্ধের
বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়
সুকান্তের কবিতা শক্তি জুগিয়েছে। সুকান্ত শ্রেণী বিভক্তির
বিরুদ্ধে ও মানুষের সম-অধিকার বাস্তবায়নের পক্ষে নিরলস
কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন অনুভূতিপ্রবণ কবি। অসহায়
মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতা ছিল
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুকান্তের কবিতা অধিকার
অর্জনের আন্দোলনকে গতিময় করতে সহায়ক হয়েছে।
শ্রমজীবী মানুষের দাবিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রকে তিনি কবিতার
উচ্চারণ দিয়ে রুখতে চেয়েছেন।
সুকান্ত নয়-দশ বছর বয়সে সাহিত্য জগতে আবির্ভূত হয়।
তার শিশুমনের ভাবনা দিয়ে তিনি কবিতা রচনা করেন—
“বল দেখি জমিদারের কোনটি ধাম
জমিদারের দুই ছেলে রাম শ্যাম,
রাম বড় ভাল ছেলে পাঠশালা যায়
শ্যাম শুধু ঘরে বসে দুধ ভাত খায়।”
সুকান্তের এ ধরনের কবিতা বিজন কুমার গঙ্গোপাধ্যায়
সম্পাদিত শিশু পত্রিকা ‘শিখায়’ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত
হতে থাকে। ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিরোধ
আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে সুকান্ত ১৯৪২
সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। কমিউনিস্ট
পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে সুকান্ত তার কবি সুভাষ
মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত ঘটে। এ সময় সুকান্ত
ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন।
এবং ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘের মুখপত্র ‘অকাল’ এর
সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। সুকান্তের ‘বোধন’
কবিতাটি সে সময়ের লেখক ও পাঠকদের আলোচনার বিষয়
হয়ে ওঠে।
“আদিম হিংস্র মানবিকতার
যদি আমি কেউ হই
স্বজন হারানো শ্মশানে তোমাদের
চিতা আমি তুলবই।”
জগদীশ ভট্টাচার্য এ কবিতাকে এ যুগের মহাকাব্য
বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন ‘বোধন’ এ যুগের
শ্রেষ্ঠ প্রেরণা, শ্রেষ্ঠ কাব্য।
সুকান্ত ম্যালেরিয়া ও টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হন।
সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই আঠারো বছর বয়সের এই
কবি কর্মক্ষেত্রে ছুটে যান। এ সময় তিনি উচ্চারণ করেন :
“আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়—
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।”
সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয়
করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-
যন্ত্রণাকে মোকাবিলা করার সাহস সুকান্তের
কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত
শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার
আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের
কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তার বক্তব্যপ্রধান
সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। ভাবনাগত
দিকে সুকান্ত তাঁর বয়স থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন।
সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও লৈখিক দক্ষতায় অনন্য।
হয়ত আরও কিছু দিন কবিতা তার সাহচর্য
পেলে একটা অভিনব স্থান উন্মোচিত হতো— এই আফসোস
বহুকালব্যাপী রয়ে যাবে বাংলায়।


Posted via Blogaway

No comments: