রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অস্তিত্ব নিয়ে আজকাল
অনেককে প্রশ্ন করতে শুনি। যারা বলেন
তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক নন, বরং বিএনপিরই
সমর্থক। অনেকে বিএনপি আমলের সুবিধাভোগী। তাদের
হতাশা হচ্ছে বিএনপিকে তারা ক্ষমতায় দেখতে পাচ্ছেন না,
ফলে ক্ষমতা থেকে যে সুবিধাটুকু তারা চান,
সেটা তারা পাচ্ছেন না।
দলের মধ্যে অন্তর্বিরোধও প্রবল ও প্রকট।
বিএনপি একটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে,
এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার
মতো বিচক্ষণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বিএনপি নেতৃত্ব কতটুকু
ধারণ করে সেটা আংশিক বাইরে থেকে আন্দাজ
করা যেতে পারে, তবে পুরোপুরি মূল্যায়ন করা কঠিন। কারণ
দলের অভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্বের চরিত্র
বাইরে থেকে পুরোপুরি বোঝা মুশকিল। নেতৃত্বের
পর্যায়ে এবং সাংগঠনিক দিক থেকে কিছুটা অদল-বদলের
চেষ্টা আছে। সেটা থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়ের
মতো। একই কারণে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের অস্তিত্ব
নিয়েও অনেকে চিন্তিত। কিন্তু রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠান
হিসেবে বিএনপির শক্তি বা ক্ষয় নিয়ে আমি খুব চিন্তিত না।
এর প্রধান কারণ বিএনপির দুর্বলতা সাংগঠনিক নয়,
আদর্শিক। সেই আদর্শিক প্রশ্ন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের
সঙ্গে জড়িত। একইভাবে জোট হিসেবে বিএনপি ও জোটবদ্ধ
দলগুলো কী ধরনের রাজনৈতিক আদর্শের ওপর তাদের
জোটের রাজনীতি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন তার ওপর শুধু
তাদের নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
তারা সেটা করবে কিনা সেটা একান্তই তাদের ব্যাপার।
নাগরিক হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করা কর্তব্য তার
ওপর জোর দেয়াটাই বেশি জরুরি।
সেই দিক থেকে রাজনীতির আদর্শগত
প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসাটাই বিচক্ষণের কাজ।
কে কী করবে সেটা তাদের যার যার নিজের ব্যাপার। অর্থাৎ
বিএনপি ও বিএনপির অধীনে জোটবদ্ধ
দলগুলো কী করবে বা করবে না সেই বৃথা তর্কে সময়
অপচয়ের কোনো কারণ দেখি না। আমি মনে করি না তাদের
ভূমিকা রাখার সুযোগ ও সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।কথাটা আমি আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের
সঙ্গে তুলনা না করে বোঝালে বোঝাতে পারব না।
স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এবং পরের আওয়ামী লীগ,
এমনকি বাকশালের কথাও আমি বলছি না।
পার্লামেন্টবাদী গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শেখ মুজিবুর রহমান
নিয়মতান্ত্রিক ও
আইনি পরিমণ্ডলে থেকে রাজনীতি চর্চা করেছেন। সেই
আওয়ামী লীগের মৃত্যু হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে।
একই সঙ্গে একাত্তরের আগের শেখ মুজিবুর রহমানের
আওয়ামী লীগেরও বটে। অর্থাৎ বাংলাদেশ শত্র“মুক্ত
হওয়ার দিন একই সঙ্গে সেই রাজনীতির মৃত্যুদিনও বটে।
শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি ততদিন আমাদের দরকার
ছিল। কী ছিল সেই রাজনীতি? নিয়মতান্ত্রিক,
আইনি পরিমণ্ডলে থেকে জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি-
দাওয়া আদায়ের জন্য গণসংগ্রামের রাজনীতি। যে রাজনীতির
যৌক্তিক পরিণতি হওয়ার কথা ছিল তার পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী হওয়া। কিন্তু তিনি সেটা হতে পারলেন না।
নিয়মতান্ত্রিক ও আইনি পরিমণ্ডলে বদ্ধ থেকে রাজনৈতিক
সংগ্রামের সীমাও আমরা এতে যেমন বুঝি, একই সঙ্গে এই
রাজনীতির শক্তি সম্পর্কেও অভিজ্ঞতা ঘটে আমাদের।
রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে এই রাজনীতি বিশ্ব
পরিমণ্ডলে আমাদের উত্থান ঘটায়। এই পরিগঠন ও উত্থান
ঘটানোর ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুরের গণআন্দোলন
গড়ে তোলা ও বিজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার ইতিহাস অনন্য।
যে ইতিহাস এই রাজনীতি স্থাপন করেছে তা অতুলনীয়। এ
নিয়ে খুব কমই গবেষণা হয়েছে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের
ইতিহাসকে কুৎসিত কায়দায় দলীয়করণ করার
কারণে কোনো প্রতিভাবান গবেষক পাকিস্তান পর্যায়ে শেখ
মুজিবুরের আন্দোলন ও সংগ্রামের নীতি ও কৌশল
নিয়ে গবেষণা করেননি। একদিন হবে অবশ্যই।
একাত্তরের পরে আমরা ভিন্ন এক শেখ মুজিবুর রহমান ও
ভিন্ন এক আওয়ামী রাজনীতি ও রাজনৈতিক আদর্শ দেখি।
ইনি শাসক, গণআন্দোলনের নেতা নন। রাষ্ট্র
কী তিনি জানেন না, নিজের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত
করতে চান। শাসন বলতে তিনি একনায়কতান্ত্রিক
ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না।
ফলে বাকশালী ক্ষমতা চর্চার ভীতিকর
রাজনীতি তিনি আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। জনগণ
সেটা প্রত্যাখ্যান করে। তাকেও। কিন্তু প্রত্যাখ্যানের
ভাষা ছিল নির্মম ও নিষ্ঠুর। আর যারা তাকে প্রত্যাখ্যানের
এই কাজটি করেন তাদের অনেকে ছিলেন একাত্তরের
মুক্তিযোদ্ধা। নির্মমতা বা নিষ্ঠুরতা শুধু তাকে হত্যার মধ্য
দিয়ে ঘটেনি, বাংলাদেশের জনগণের দিক থেকেও ঘটেছে,
কারণ এর ট্রাজিক দিক হচ্ছে শেখ মুজিব
হত্যাকাণ্ডে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জড়িত করেছিলেন।
বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে হলে একদিন তাদের ইতিহাসও
লিখতে হবে।
পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশে প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয়েছে, এখন কাজ হচ্ছে রাষ্ট্র
গঠন করা। শেখ মুজিব নিজের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের
রাজনীতি ছাড়া আমাদের আর কিছুই দিতে পারেননি। জিয়াউর
রহমানের উদ্ভব ঘটল সাধারণ সৈনিক ও সাধারণ
খেটে খাওয়া জনগণের মৈত্রীর ফলাফল হিসেবে।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান নিজে তার প্রতীক হয়েই
ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারলেন।
সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে গিয়ে তিনি অনেক
অপ্রীতিকর ও নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। ইতিহাস
কীভাবে তার মূল্যায়ন করবে সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু
বাংলাদেশের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক মুহূর্ত আদৌ কিছু
উপলব্ধি করেছিলেন কি-না তার পক্ষে বিশেষ কোনো প্রমাণ
নেই। যার ফলে বিএনপির কোনো নেতা বা কর্মীর
কাছে আমরা সাধারণ সৈনিক ও সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণের
মৈত্রী সম্পর্কে কিছুই শুনি না।
এটা উপলব্ধি করা বা বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু
তিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে তৈরি অর্থাৎ
বিএনপি সেনা ক্যান্টনমেন্টের দল এই আওয়ামী মিথ
মেনে নেয়ার কোনো যুক্তি নেই।সার কথা হচ্ছে, তার উত্থান বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির
সম্ভাবনা সূচনা করে, যার প্রধান ও একমাত্র কাজ
হচ্ছে স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশের
জনগণকে নিয়ে একটি মজবুত ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্র গঠন করা। যার ভিত্তি হতে পারত সাধারণ সৈনিক ও
জনগণের বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক মৈত্রী। বাংলাদেশের
রাজনীতিতে এই সম্ভাবনা ক্ষণিক বিদ্যুৎ চমকের
মতো দেখা দিয়েছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা বজ্রপাতের
আওয়াজ দিয়েই সেটা শেষ হয়ে যায়। কেন এটা ঘটল?
জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তিনি ঘটনার
স্বতঃস্ফূর্ততা সামাল দিয়ে নিজেকে ধরে রাখার
চেষ্টা করেছিলেন মাত্র। সামরিক শাসন ছাড়া অন্য
কোনো শাসন পদ্ধতিও তার জানা ছিল না। সামরিক শাসক
হওয়ার পরও তিনি আন্তর্জাতিক মহলে টিকে যান। এর কারণ
বিশ্বব্যাপী তখন অবাধ বাজার ব্যবস্থার উত্থানের যুগ।
আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্র বা রাষ্ট্রীয়
সম্পত্তি আওয়ামী নেতাকর্মী ও আমলাদের হাতিয়ে নেয়ার
তত্ত্বের বিপরীতে তিনি বাজার ব্যবস্থার
পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ তাকে মিত্র
মনে করেছিল। অবাধ বাজার তত্ত্বের তখন সবে রমরমা।
তিনি সেই তত্ত্বের বার্তাবাহক ও
আমলকারী হিসেবে বাংলাদেশে হাজির হয়েছিলেন,
ফলে সামরিক শাসক হয়েও টিকে গিয়েছিলেন।
তিনি একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা চর্চা করেছেন কিন্তু
একনায়কতান্ত্রিকতা রাজনীতির জন্য ইতিবাচক মনে করতেন
না। যার কারণে সামরিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছিলেন
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্স্থাপনের কাজে। তিনি রাজনৈতিক
দলগুলোকে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ যেমন
সৃষ্টি করেছেন, একইভাবে নিজেও নতুন একটি রাজনৈতিক
দলের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান কোনো জাতীয়
আদর্শ দাঁড় করাতে পারেননি, যাতে গণতান্ত্রিক আদর্শের
ওপর একটি মজবুত রাষ্ট্র গঠন করা যায়।
একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আদর্শ ও গতিশীল বাজার
ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক
সংস্কৃতি ছিল বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট। ফলে বিপুল
সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
আওয়ামী লীগ বিরোধিতার অধিক বা অতিরিক্ত
কোনো আদর্শ পয়দা করতে পারেনি। অর্থাৎ
মতাদর্শিকভাবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পরাস্ত করার কোনো মতাদর্শিক
বয়ান খাড়া করতে পারেনি। মতাদর্শিক ইতিহাসের দিক
থেকে বিচার করলে বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান পরিণতির
প্রধান কারণ এই ব্যর্থতার মধ্যে নিহিত। বিএনপির বর্তমান
দুর্দশার কারণও এখানে। সাংগঠনিক ব্যর্থতার
কেচ্ছা এখানে গৌণ। এই ব্যর্থতাই শেখ হাসিনার
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা নব্য
বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদের জন্য জমিন তৈরি করেছে।
শেখ হাসিনার অসামান্য প্রতিভা যে, তিনি কার্যত
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য
বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি শক্তিশালী নব্য
ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ
হিসেবে সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। তার
সাফল্যের বড় কারণ হচ্ছে অবাধ বাজার ব্যবস্থা ও নতুন
ইনফরমেশন টেকনোলজির সুবাদে একটি নতুন
শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম, যারা বাংলাদেশের
ইতিহাসকে নয় মাসের আওয়ামী ফিকশন হিসেবে বিশ্বাস
করে ও গ্রহণ করে শুধু তাই নয়, তারা বাংলাদেশের
জনগণকে শেখ হাসিনার পরিকল্পনা মোতাবেক বিভক্ত ও
বিভাজিত করতে ও রাখতে রাজি। গণমাধ্যমের বড় অংশই
এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সহযোগী। অর্থাৎ নব্য
ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ও ক্ষমতার বিপরীতে তারা লিবারেল
বা উদার গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার চর্চা করতেও
অনাগ্রহী। আওয়ামী ভার্চুয়াল ফিকশন সাময়িক
এবং একে মোকাবেলা কঠিন কিছু ছিল না। এর
বিপরীতে একটি শক্তিশালী আদর্শিক রাজনীতি খাড়া করাই
ছিল ইতিহাসের দাবি। কিন্তু জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর
বুর্জোয়া দল হিসেবে বিএনপি সেই কাজ উপেক্ষা করে। তার
কাফফারা বিএনপিকে এখন গুনতে হবে।
বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা আছে, কিন্তু তার জন্য
বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট
ক্ষয়ে যাবে এটা আমি মনে করি না। শেখ হাসিনা তার নব্য
ফ্যাসিবাদকে বাংলাদেশের সংবিধানের অন্তর্গত
করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। ফ্যাসিবাদ এখন শুধু দলীয়
মতাদর্শ না। এটা এখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে সংগঠিত ও
সংহত। এর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যে আদর্শিক প্রস্তুতি ও
হিম্মত দরকার সেটা বিএনপি ও তার অধীনস্থ জোটের নেই,
এটাই সত্য কথা। এটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র
হিসেবে বাংলাদেশকে গঠন করার কাজ। যে কাজ শুরুই হয়নি,
সেই কাজ করা। পুনর্গঠনের কাজ নয়। এমন নয় যে বাংলাদেশ
একসময় গণতান্ত্রিক ছিল, এখন তাকে সেই আগের
মতো পুনর্গঠিত করতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র কখনোই
গণতান্ত্রিক ছিল না। যে কারণে শুরুতে বলেছি, বিএনপি ও
জোটবদ্ধ দলগুলো কী ধরনের রাজনৈতিক আদর্শের ওপর
তাদের জোটের রাজনীতি দাঁড় করানোর চেষ্টা করবেন তার
ওপর শুধু তাদের নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
তাহলে রাজনৈতিক মতাদর্শিক দিক থেকে বিএনপি ও তার
নেতৃত্বাধীন জোটের ভূমিকা একাত্তরের আগে শেখ মুজিবের
আওয়ামী লীগের মতো শেষ হয়ে যায়নি। বরং নতুন
পরিস্থিতিতে ও নতুন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই জোট
গণতান্ত্রিক রাজনীতির
কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারে কিনা তার ওপর এই জোটের
ভবিষ্যৎ যেমন নির্ভর করছে, একই সঙ্গে বাংলাদেশেরও।
বর্তমান পরিস্থিতি অতিক্রম করে যাওয়ার আর
কোনো বিকল্প পথ নেই।
পঁচাত্তরের পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ,
সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র এই চার নীতির ওপর
দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ যে রাজনীতি করেছে, তারই ফল শেখ
হাসিনা ও বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান। বিচারকদের
অভিশংসনের ক্ষমতা সংবিধানের ১৬ নম্বর সংশোধনীর মধ্য
দিয়ে জাতীয় সংসদের হাতে নিয়ে শেখ
হাসিনা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সংবিধান বলি, আইন বলি, শাসন
বলি, ক্ষমতা বলি সবই তার হাতে কুক্ষিগত। তিনি একাই এই
ক্ষমতার অনন্য প্রতীক। পৃথিবীর খুব কম দেশের
ইতিহাসে এ ধরনের অসামান্য ঘটনা ঘটে। এর
পক্ষে গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ নির্বিচারে দাঁড়ায় সেটাও
দেখা যায় না। এই এক পরাবাস্তব ভুতুড়ে পরিস্থিতি।
ভুতুড়ে বললে তা সহজে কেটে যাবে এটা ভাবার কোনো কারণ
নেই।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপি এখনও ভাঙা রেকর্ডের
মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে চলেছে। জনগণের
কাছে দুটো বিষয় জরুরি। এক. বিদ্যমান রাষ্ট্র
ব্যবস্থা বদলানো, দুই. সেই কাজ করতে হলে সুনির্দিষ্ট
দাবি-দাওয়াগুলো কী হবে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের সশস্ত্র
শক্তিকে বিরোধী দল ও জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন।
এ পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক লড়াই-
সংগ্রামে জয়ী হতে হলে গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়া সুস্পষ্ট
ও পরিচ্ছন্নভাবে হাজির করা দরকার। খালেদা জিয়া ও
বিরোধীদলীয় জোটের সামনে এটাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।
জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা ধারণ করতে পারে সেই
ধরনের দাবি-দাওয়া কেমন হতে পারে? এ
ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি। আবারও বলি। জনগণের প্রথম
ও প্রধান গণতান্ত্রিক দাবি হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র
ব্যবস্থার বিপরীতে নাগরিক ও মানবিক অধিকার সংবলিত
একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র। এর জন্য দরকার
ইসলাম-বিদ্বেষী রাজনীতি জনগণকে যেভাবে বিভক্ত ও
বিষাক্ত করেছে, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে জনগণের
মধ্যে সেই বিভক্তির নিরসন। বিশেষ বিশেষ আত্মপরিচয়ের
সামাজিক পরিমণ্ডলের ঊর্ধ্বে জনগণের মধ্যে নাগরিক
চেতনার উন্মেষ ঘটানো। যাতে রাজনৈতিক
জনগোষ্ঠী হিসেবে জনগণের পরিগঠন মজবুত করা যায়। নতুন
গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা এ কারণেই
আমরা বারবার বলি।
দুই. বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জনগণের
নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য জনগণের
অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী জাতীয়
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ক্ষুদ্র দেশ
চতুর্দিকে বৈরী রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকলে চরিত্রের
দিক থেকে এই ব্যবস্থা গণপ্রতিরক্ষার চরিত্র পরিগ্রহণ
করে বা করতে বাধ্য। অর্থাৎ শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষার
অর্থ গণপ্রতিরক্ষা।
জনগণের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ আকাক্সক্ষা হচ্ছে, জীবন-
জীবিকা ও সামাজিক ইনসাফ নিশ্চিত করার দাবি। শ্রমিকদের
ন্যূনতম আট হাজার টাকা মজুরি নিশ্চিত
করা এবং কৃষককে অবাধ বাজার ব্যবস্থার শোষণ
থেকে রক্ষা করা; বিশেষত কৃষি ও খাদ্য
ব্যবস্থাকে বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশের দুষ্ট ব্যবসায়ীদের
হাত থেকে রক্ষা করা প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠেছে। কৃষকের
হাতে থাকা খাদ্য ও বীজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস
করে তা কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার পথ আÍঘাতী পথ। এই
পথ থেকে দ্রুত ফিরে আসতে হবে।
চতুর্থ ইস্যু হচ্ছে প্রাণ, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা।
এ দিকটির প্রতি আন্তরিক ও পূর্ণ মনোযোগ ছাড়া এ
কালে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রই টেকসই হতে পারে না।
পঞ্চম দাবি হচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়
বাংলাদেশের অবস্থান মজবুত করা। পুঁজিতান্ত্রিক
বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম ও
মজবুত করে তোলার সঠিক অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন ও
সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এই নীতির
মর্মকথা বাজার ব্যবস্থাকে অবাধ করা নয়, আবার
রাষ্ট্রায়ত্তকরণও নয়, সমাজতন্ত্রের নামে ব্যক্তির
প্রণোদনা ও উদ্যোগকে যেভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল
তাও নয়। বরং দরকার বাজার ব্যবস্থাকে উপযুক্ত সামাজিক
ও রাষ্ট্রীয় নীতি ও শৃংখলার অধীনে এনে বিনিয়োগ ও
কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অভিমুখী করা। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক
ব্যবস্থার প্রান্তে থেকেও বিভিন্ন দেশ কীভাবে অর্থনৈতিক
সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে গেছে সে উদাহরণ এখন আমাদের
সামনে আছে। তার সীমা, সম্ভাবনা ভালো-মন্দ বিচার
করে বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত অর্থনৈতিক উন্নতির
নীতি প্রণয়ন কঠিন কোনো কাজ নয়।
আমি মনে করি এই পাঁচটি সংক্ষিপ্ত অথচ মৌলিক
গণতান্ত্রিক দাবি লিবারেল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের দাবি।
অনেককে প্রশ্ন করতে শুনি। যারা বলেন
তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক নন, বরং বিএনপিরই
সমর্থক। অনেকে বিএনপি আমলের সুবিধাভোগী। তাদের
হতাশা হচ্ছে বিএনপিকে তারা ক্ষমতায় দেখতে পাচ্ছেন না,
ফলে ক্ষমতা থেকে যে সুবিধাটুকু তারা চান,
সেটা তারা পাচ্ছেন না।
দলের মধ্যে অন্তর্বিরোধও প্রবল ও প্রকট।
বিএনপি একটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে,
এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার
মতো বিচক্ষণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বিএনপি নেতৃত্ব কতটুকু
ধারণ করে সেটা আংশিক বাইরে থেকে আন্দাজ
করা যেতে পারে, তবে পুরোপুরি মূল্যায়ন করা কঠিন। কারণ
দলের অভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্বের চরিত্র
বাইরে থেকে পুরোপুরি বোঝা মুশকিল। নেতৃত্বের
পর্যায়ে এবং সাংগঠনিক দিক থেকে কিছুটা অদল-বদলের
চেষ্টা আছে। সেটা থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়ের
মতো। একই কারণে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের অস্তিত্ব
নিয়েও অনেকে চিন্তিত। কিন্তু রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠান
হিসেবে বিএনপির শক্তি বা ক্ষয় নিয়ে আমি খুব চিন্তিত না।
এর প্রধান কারণ বিএনপির দুর্বলতা সাংগঠনিক নয়,
আদর্শিক। সেই আদর্শিক প্রশ্ন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের
সঙ্গে জড়িত। একইভাবে জোট হিসেবে বিএনপি ও জোটবদ্ধ
দলগুলো কী ধরনের রাজনৈতিক আদর্শের ওপর তাদের
জোটের রাজনীতি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন তার ওপর শুধু
তাদের নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
তারা সেটা করবে কিনা সেটা একান্তই তাদের ব্যাপার।
নাগরিক হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করা কর্তব্য তার
ওপর জোর দেয়াটাই বেশি জরুরি।
সেই দিক থেকে রাজনীতির আদর্শগত
প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসাটাই বিচক্ষণের কাজ।
কে কী করবে সেটা তাদের যার যার নিজের ব্যাপার। অর্থাৎ
বিএনপি ও বিএনপির অধীনে জোটবদ্ধ
দলগুলো কী করবে বা করবে না সেই বৃথা তর্কে সময়
অপচয়ের কোনো কারণ দেখি না। আমি মনে করি না তাদের
ভূমিকা রাখার সুযোগ ও সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।কথাটা আমি আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের
সঙ্গে তুলনা না করে বোঝালে বোঝাতে পারব না।
স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এবং পরের আওয়ামী লীগ,
এমনকি বাকশালের কথাও আমি বলছি না।
পার্লামেন্টবাদী গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শেখ মুজিবুর রহমান
নিয়মতান্ত্রিক ও
আইনি পরিমণ্ডলে থেকে রাজনীতি চর্চা করেছেন। সেই
আওয়ামী লীগের মৃত্যু হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে।
একই সঙ্গে একাত্তরের আগের শেখ মুজিবুর রহমানের
আওয়ামী লীগেরও বটে। অর্থাৎ বাংলাদেশ শত্র“মুক্ত
হওয়ার দিন একই সঙ্গে সেই রাজনীতির মৃত্যুদিনও বটে।
শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি ততদিন আমাদের দরকার
ছিল। কী ছিল সেই রাজনীতি? নিয়মতান্ত্রিক,
আইনি পরিমণ্ডলে থেকে জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি-
দাওয়া আদায়ের জন্য গণসংগ্রামের রাজনীতি। যে রাজনীতির
যৌক্তিক পরিণতি হওয়ার কথা ছিল তার পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী হওয়া। কিন্তু তিনি সেটা হতে পারলেন না।
নিয়মতান্ত্রিক ও আইনি পরিমণ্ডলে বদ্ধ থেকে রাজনৈতিক
সংগ্রামের সীমাও আমরা এতে যেমন বুঝি, একই সঙ্গে এই
রাজনীতির শক্তি সম্পর্কেও অভিজ্ঞতা ঘটে আমাদের।
রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে এই রাজনীতি বিশ্ব
পরিমণ্ডলে আমাদের উত্থান ঘটায়। এই পরিগঠন ও উত্থান
ঘটানোর ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুরের গণআন্দোলন
গড়ে তোলা ও বিজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার ইতিহাস অনন্য।
যে ইতিহাস এই রাজনীতি স্থাপন করেছে তা অতুলনীয়। এ
নিয়ে খুব কমই গবেষণা হয়েছে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের
ইতিহাসকে কুৎসিত কায়দায় দলীয়করণ করার
কারণে কোনো প্রতিভাবান গবেষক পাকিস্তান পর্যায়ে শেখ
মুজিবুরের আন্দোলন ও সংগ্রামের নীতি ও কৌশল
নিয়ে গবেষণা করেননি। একদিন হবে অবশ্যই।
একাত্তরের পরে আমরা ভিন্ন এক শেখ মুজিবুর রহমান ও
ভিন্ন এক আওয়ামী রাজনীতি ও রাজনৈতিক আদর্শ দেখি।
ইনি শাসক, গণআন্দোলনের নেতা নন। রাষ্ট্র
কী তিনি জানেন না, নিজের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত
করতে চান। শাসন বলতে তিনি একনায়কতান্ত্রিক
ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না।
ফলে বাকশালী ক্ষমতা চর্চার ভীতিকর
রাজনীতি তিনি আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। জনগণ
সেটা প্রত্যাখ্যান করে। তাকেও। কিন্তু প্রত্যাখ্যানের
ভাষা ছিল নির্মম ও নিষ্ঠুর। আর যারা তাকে প্রত্যাখ্যানের
এই কাজটি করেন তাদের অনেকে ছিলেন একাত্তরের
মুক্তিযোদ্ধা। নির্মমতা বা নিষ্ঠুরতা শুধু তাকে হত্যার মধ্য
দিয়ে ঘটেনি, বাংলাদেশের জনগণের দিক থেকেও ঘটেছে,
কারণ এর ট্রাজিক দিক হচ্ছে শেখ মুজিব
হত্যাকাণ্ডে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জড়িত করেছিলেন।
বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে হলে একদিন তাদের ইতিহাসও
লিখতে হবে।
পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশে প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয়েছে, এখন কাজ হচ্ছে রাষ্ট্র
গঠন করা। শেখ মুজিব নিজের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের
রাজনীতি ছাড়া আমাদের আর কিছুই দিতে পারেননি। জিয়াউর
রহমানের উদ্ভব ঘটল সাধারণ সৈনিক ও সাধারণ
খেটে খাওয়া জনগণের মৈত্রীর ফলাফল হিসেবে।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান নিজে তার প্রতীক হয়েই
ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারলেন।
সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে গিয়ে তিনি অনেক
অপ্রীতিকর ও নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। ইতিহাস
কীভাবে তার মূল্যায়ন করবে সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু
বাংলাদেশের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক মুহূর্ত আদৌ কিছু
উপলব্ধি করেছিলেন কি-না তার পক্ষে বিশেষ কোনো প্রমাণ
নেই। যার ফলে বিএনপির কোনো নেতা বা কর্মীর
কাছে আমরা সাধারণ সৈনিক ও সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণের
মৈত্রী সম্পর্কে কিছুই শুনি না।
এটা উপলব্ধি করা বা বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু
তিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে তৈরি অর্থাৎ
বিএনপি সেনা ক্যান্টনমেন্টের দল এই আওয়ামী মিথ
মেনে নেয়ার কোনো যুক্তি নেই।সার কথা হচ্ছে, তার উত্থান বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির
সম্ভাবনা সূচনা করে, যার প্রধান ও একমাত্র কাজ
হচ্ছে স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশের
জনগণকে নিয়ে একটি মজবুত ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্র গঠন করা। যার ভিত্তি হতে পারত সাধারণ সৈনিক ও
জনগণের বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক মৈত্রী। বাংলাদেশের
রাজনীতিতে এই সম্ভাবনা ক্ষণিক বিদ্যুৎ চমকের
মতো দেখা দিয়েছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা বজ্রপাতের
আওয়াজ দিয়েই সেটা শেষ হয়ে যায়। কেন এটা ঘটল?
জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তিনি ঘটনার
স্বতঃস্ফূর্ততা সামাল দিয়ে নিজেকে ধরে রাখার
চেষ্টা করেছিলেন মাত্র। সামরিক শাসন ছাড়া অন্য
কোনো শাসন পদ্ধতিও তার জানা ছিল না। সামরিক শাসক
হওয়ার পরও তিনি আন্তর্জাতিক মহলে টিকে যান। এর কারণ
বিশ্বব্যাপী তখন অবাধ বাজার ব্যবস্থার উত্থানের যুগ।
আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্র বা রাষ্ট্রীয়
সম্পত্তি আওয়ামী নেতাকর্মী ও আমলাদের হাতিয়ে নেয়ার
তত্ত্বের বিপরীতে তিনি বাজার ব্যবস্থার
পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ তাকে মিত্র
মনে করেছিল। অবাধ বাজার তত্ত্বের তখন সবে রমরমা।
তিনি সেই তত্ত্বের বার্তাবাহক ও
আমলকারী হিসেবে বাংলাদেশে হাজির হয়েছিলেন,
ফলে সামরিক শাসক হয়েও টিকে গিয়েছিলেন।
তিনি একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা চর্চা করেছেন কিন্তু
একনায়কতান্ত্রিকতা রাজনীতির জন্য ইতিবাচক মনে করতেন
না। যার কারণে সামরিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছিলেন
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্স্থাপনের কাজে। তিনি রাজনৈতিক
দলগুলোকে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ যেমন
সৃষ্টি করেছেন, একইভাবে নিজেও নতুন একটি রাজনৈতিক
দলের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান কোনো জাতীয়
আদর্শ দাঁড় করাতে পারেননি, যাতে গণতান্ত্রিক আদর্শের
ওপর একটি মজবুত রাষ্ট্র গঠন করা যায়।
একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আদর্শ ও গতিশীল বাজার
ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক
সংস্কৃতি ছিল বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট। ফলে বিপুল
সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
আওয়ামী লীগ বিরোধিতার অধিক বা অতিরিক্ত
কোনো আদর্শ পয়দা করতে পারেনি। অর্থাৎ
মতাদর্শিকভাবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পরাস্ত করার কোনো মতাদর্শিক
বয়ান খাড়া করতে পারেনি। মতাদর্শিক ইতিহাসের দিক
থেকে বিচার করলে বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান পরিণতির
প্রধান কারণ এই ব্যর্থতার মধ্যে নিহিত। বিএনপির বর্তমান
দুর্দশার কারণও এখানে। সাংগঠনিক ব্যর্থতার
কেচ্ছা এখানে গৌণ। এই ব্যর্থতাই শেখ হাসিনার
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা নব্য
বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদের জন্য জমিন তৈরি করেছে।
শেখ হাসিনার অসামান্য প্রতিভা যে, তিনি কার্যত
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য
বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি শক্তিশালী নব্য
ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ
হিসেবে সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। তার
সাফল্যের বড় কারণ হচ্ছে অবাধ বাজার ব্যবস্থা ও নতুন
ইনফরমেশন টেকনোলজির সুবাদে একটি নতুন
শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম, যারা বাংলাদেশের
ইতিহাসকে নয় মাসের আওয়ামী ফিকশন হিসেবে বিশ্বাস
করে ও গ্রহণ করে শুধু তাই নয়, তারা বাংলাদেশের
জনগণকে শেখ হাসিনার পরিকল্পনা মোতাবেক বিভক্ত ও
বিভাজিত করতে ও রাখতে রাজি। গণমাধ্যমের বড় অংশই
এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সহযোগী। অর্থাৎ নব্য
ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ও ক্ষমতার বিপরীতে তারা লিবারেল
বা উদার গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার চর্চা করতেও
অনাগ্রহী। আওয়ামী ভার্চুয়াল ফিকশন সাময়িক
এবং একে মোকাবেলা কঠিন কিছু ছিল না। এর
বিপরীতে একটি শক্তিশালী আদর্শিক রাজনীতি খাড়া করাই
ছিল ইতিহাসের দাবি। কিন্তু জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর
বুর্জোয়া দল হিসেবে বিএনপি সেই কাজ উপেক্ষা করে। তার
কাফফারা বিএনপিকে এখন গুনতে হবে।
বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা আছে, কিন্তু তার জন্য
বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট
ক্ষয়ে যাবে এটা আমি মনে করি না। শেখ হাসিনা তার নব্য
ফ্যাসিবাদকে বাংলাদেশের সংবিধানের অন্তর্গত
করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। ফ্যাসিবাদ এখন শুধু দলীয়
মতাদর্শ না। এটা এখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে সংগঠিত ও
সংহত। এর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যে আদর্শিক প্রস্তুতি ও
হিম্মত দরকার সেটা বিএনপি ও তার অধীনস্থ জোটের নেই,
এটাই সত্য কথা। এটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র
হিসেবে বাংলাদেশকে গঠন করার কাজ। যে কাজ শুরুই হয়নি,
সেই কাজ করা। পুনর্গঠনের কাজ নয়। এমন নয় যে বাংলাদেশ
একসময় গণতান্ত্রিক ছিল, এখন তাকে সেই আগের
মতো পুনর্গঠিত করতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র কখনোই
গণতান্ত্রিক ছিল না। যে কারণে শুরুতে বলেছি, বিএনপি ও
জোটবদ্ধ দলগুলো কী ধরনের রাজনৈতিক আদর্শের ওপর
তাদের জোটের রাজনীতি দাঁড় করানোর চেষ্টা করবেন তার
ওপর শুধু তাদের নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
তাহলে রাজনৈতিক মতাদর্শিক দিক থেকে বিএনপি ও তার
নেতৃত্বাধীন জোটের ভূমিকা একাত্তরের আগে শেখ মুজিবের
আওয়ামী লীগের মতো শেষ হয়ে যায়নি। বরং নতুন
পরিস্থিতিতে ও নতুন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই জোট
গণতান্ত্রিক রাজনীতির
কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারে কিনা তার ওপর এই জোটের
ভবিষ্যৎ যেমন নির্ভর করছে, একই সঙ্গে বাংলাদেশেরও।
বর্তমান পরিস্থিতি অতিক্রম করে যাওয়ার আর
কোনো বিকল্প পথ নেই।
পঁচাত্তরের পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ,
সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র এই চার নীতির ওপর
দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ যে রাজনীতি করেছে, তারই ফল শেখ
হাসিনা ও বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান। বিচারকদের
অভিশংসনের ক্ষমতা সংবিধানের ১৬ নম্বর সংশোধনীর মধ্য
দিয়ে জাতীয় সংসদের হাতে নিয়ে শেখ
হাসিনা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সংবিধান বলি, আইন বলি, শাসন
বলি, ক্ষমতা বলি সবই তার হাতে কুক্ষিগত। তিনি একাই এই
ক্ষমতার অনন্য প্রতীক। পৃথিবীর খুব কম দেশের
ইতিহাসে এ ধরনের অসামান্য ঘটনা ঘটে। এর
পক্ষে গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ নির্বিচারে দাঁড়ায় সেটাও
দেখা যায় না। এই এক পরাবাস্তব ভুতুড়ে পরিস্থিতি।
ভুতুড়ে বললে তা সহজে কেটে যাবে এটা ভাবার কোনো কারণ
নেই।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপি এখনও ভাঙা রেকর্ডের
মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে চলেছে। জনগণের
কাছে দুটো বিষয় জরুরি। এক. বিদ্যমান রাষ্ট্র
ব্যবস্থা বদলানো, দুই. সেই কাজ করতে হলে সুনির্দিষ্ট
দাবি-দাওয়াগুলো কী হবে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের সশস্ত্র
শক্তিকে বিরোধী দল ও জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন।
এ পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক লড়াই-
সংগ্রামে জয়ী হতে হলে গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়া সুস্পষ্ট
ও পরিচ্ছন্নভাবে হাজির করা দরকার। খালেদা জিয়া ও
বিরোধীদলীয় জোটের সামনে এটাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।
জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা ধারণ করতে পারে সেই
ধরনের দাবি-দাওয়া কেমন হতে পারে? এ
ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি। আবারও বলি। জনগণের প্রথম
ও প্রধান গণতান্ত্রিক দাবি হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র
ব্যবস্থার বিপরীতে নাগরিক ও মানবিক অধিকার সংবলিত
একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র। এর জন্য দরকার
ইসলাম-বিদ্বেষী রাজনীতি জনগণকে যেভাবে বিভক্ত ও
বিষাক্ত করেছে, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে জনগণের
মধ্যে সেই বিভক্তির নিরসন। বিশেষ বিশেষ আত্মপরিচয়ের
সামাজিক পরিমণ্ডলের ঊর্ধ্বে জনগণের মধ্যে নাগরিক
চেতনার উন্মেষ ঘটানো। যাতে রাজনৈতিক
জনগোষ্ঠী হিসেবে জনগণের পরিগঠন মজবুত করা যায়। নতুন
গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা এ কারণেই
আমরা বারবার বলি।
দুই. বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জনগণের
নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য জনগণের
অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী জাতীয়
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ক্ষুদ্র দেশ
চতুর্দিকে বৈরী রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকলে চরিত্রের
দিক থেকে এই ব্যবস্থা গণপ্রতিরক্ষার চরিত্র পরিগ্রহণ
করে বা করতে বাধ্য। অর্থাৎ শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষার
অর্থ গণপ্রতিরক্ষা।
জনগণের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ আকাক্সক্ষা হচ্ছে, জীবন-
জীবিকা ও সামাজিক ইনসাফ নিশ্চিত করার দাবি। শ্রমিকদের
ন্যূনতম আট হাজার টাকা মজুরি নিশ্চিত
করা এবং কৃষককে অবাধ বাজার ব্যবস্থার শোষণ
থেকে রক্ষা করা; বিশেষত কৃষি ও খাদ্য
ব্যবস্থাকে বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশের দুষ্ট ব্যবসায়ীদের
হাত থেকে রক্ষা করা প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠেছে। কৃষকের
হাতে থাকা খাদ্য ও বীজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস
করে তা কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার পথ আÍঘাতী পথ। এই
পথ থেকে দ্রুত ফিরে আসতে হবে।
চতুর্থ ইস্যু হচ্ছে প্রাণ, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা।
এ দিকটির প্রতি আন্তরিক ও পূর্ণ মনোযোগ ছাড়া এ
কালে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রই টেকসই হতে পারে না।
পঞ্চম দাবি হচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়
বাংলাদেশের অবস্থান মজবুত করা। পুঁজিতান্ত্রিক
বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম ও
মজবুত করে তোলার সঠিক অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন ও
সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এই নীতির
মর্মকথা বাজার ব্যবস্থাকে অবাধ করা নয়, আবার
রাষ্ট্রায়ত্তকরণও নয়, সমাজতন্ত্রের নামে ব্যক্তির
প্রণোদনা ও উদ্যোগকে যেভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল
তাও নয়। বরং দরকার বাজার ব্যবস্থাকে উপযুক্ত সামাজিক
ও রাষ্ট্রীয় নীতি ও শৃংখলার অধীনে এনে বিনিয়োগ ও
কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অভিমুখী করা। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক
ব্যবস্থার প্রান্তে থেকেও বিভিন্ন দেশ কীভাবে অর্থনৈতিক
সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে গেছে সে উদাহরণ এখন আমাদের
সামনে আছে। তার সীমা, সম্ভাবনা ভালো-মন্দ বিচার
করে বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত অর্থনৈতিক উন্নতির
নীতি প্রণয়ন কঠিন কোনো কাজ নয়।
আমি মনে করি এই পাঁচটি সংক্ষিপ্ত অথচ মৌলিক
গণতান্ত্রিক দাবি লিবারেল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের দাবি।
posted from Bloggeroid
No comments:
Post a Comment