Headlines



gazitv2

w41j

gazitv

Tuesday, September 9, 2014

ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে: ‘দাম্পত্য ধর্ষণ’

মাত্র আঠারো ঘণ্টার নোটিশে বিয়ে হল শামার (ছদ্মনাম)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যে পড়ুয়া চটপটে মেয়ে সে। পাত্র
পাওয়া গেল মনের মতন। তাই পরিবার থেকে শেষ
মুহূর্তে ওকে জানানো হলো- ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে। বাসর
ঘরে বসে স্বামীর জন্য
অপেক্ষা করতে করতে শামা মনে মনে ঠিক করছিল
কীভাবে শুরু হবে দু‘জনের বন্ধুত্ব, সারাজীবনের পথচলা।
কিন্তু স্বামী ঘরে ঢুকেই কোনও কথার আগেই হামলে পড়ল
শামার শরীরের উপর। মানসিক আর শারীরিক যন্ত্রণায়
চিৎকার করে উঠলে শামার মুখে গুঁজে দেওয়া হল কম্বল।
এভাবেই চলত প্রতিরাত। ওর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বা শারীরিক
অসুবিধার প্রতি কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। আইনের আশ্রয়
নেওয়া তো দূরের কথা; মাকে পর্যন্ত বলা হয়নি লজ্জায়।
কিন্তু ধীরে ধীরে শারীরিক আর যৌন নির্যাতন বাড়তে লাগল,
সমস্ত শরীরে জখম আর কালশিটে দাগ। উপায়ান্তর
না দেখে সাত মাসের গর্ভাবস্থায়
মেয়েটি পালিয়ে চলে এলো মায়ের কাছে। তারপর শারীরিক
নির্যাতনের কারণ দেখিয়ে ডিভোর্স নেওয়া হল।
গল্প হলেও এটা সত্য। এটা শুধু শামার একার গল্প নয়,
অনেকের জীবনের অপ্রকাশিত গল্প। স্বামী কর্তৃক
স্ত্রী শারীরিক নিযার্তনের শিকার
হলে ভুক্তভোগী স্ত্রী আইনের আশ্রয় নিতে পারে –
আমরা ধীরে হলেও এই ব্যাপারটা মেনে নিতে শিখেছি। কিন্তু
স্বামী কর্তৃক স্ত্রী ধর্ষিত
হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে আইনে এর প্রতিকারের
ব্যবস্থা থাকা উচিত অর্থাৎ ধর্ষণের দায়ে ধর্ষক
স্বামীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত -এ ধারণা এখনও
আমাদের নেই। দাম্পত্য ধর্ষণ বা ম্যারিটাল রেপ এখনও
অনুচ্চারিত আর অপরিচিত একটি শব্দ আমাদের কাছে।
এর পেছনের মূল কারণ আমাদের সামাজিক
অবকাঠামো আমাদের শেখায়- স্ত্রী হলো স্বামীর সম্পত্তির
মতো। সুতরাং বিয়ে শুধু নারী পুরুষের মাঝে একটি সামাজিক
আর ধর্মীয় চুক্তি নয়; ধরেই নেওয়া হয় বিয়ে স্বামীর
ইচ্ছে মতো স্ত্রীকে ভোগ করার একটি বৈধ লাইসেন্সও।
দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় আইনের ভাষায় ধর্ষণের
যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেখানে ধর্ষকের
ভূমিকা থেকে সযত্নে মুক্তি দেওয়া হয়েছে স্বামীকে (যদি স্ত্রী ১৩
বছরের নিচে না হয়)। অর্থাৎ স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে তার
সাথে শারীরিক সম্পর্ক করা স্বামীর জন্য কোনও অপরাধ
নয়। আর তাই স্বামীর হাতে প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের
শিকার স্ত্রী একে ধর্ষণ নামটুকু পর্যন্ত দিতে পারে না;
প্রতিকার চাওয়া তো সেখানে অকল্পনীয়।
কিন্তু এভাবে নীরবে সয়ে যাওয়া আর কতদিন? আশার কথা,
দেরিতে হলেও আন্তর্জাতিক আইন ম্যারিটাল রেপ
বা দাম্পত্য ধর্ষণকে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য
হিসাবে অবিহিত করেছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১১
এর এপ্রিল পযর্ন্ত পৃথিবীর ৫২টি দেশ ম্যারিটাল
রেপকে আইনের অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং শাস্তির বিধান
রেখেছে। ইংল্যান্ডে ১৯৯২ সালে হাউজ অব লর্ডস
স্ত্রীকে ধর্ষণের অপরাধ থেকে স্বামীর অব্যাহতির
আইনকে অবলুপ্ত করে। ১৯৯৩ সালের জুলাই
থেকে যুক্তরাষ্ট্র সব স্টেটে দাম্পত্য ধর্ষণকে বে-
আইনী ঘোষণা করেছে ।
দাম্পত্য ধর্ষণকে অপরাধে অন্তর্ভুক্ত করা দেশগুলোর
মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা, মেক্সিকো অন্যতম।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখ্য আফগানিস্তান,
মালয়েশিয়া ও নেপাল। তবে দাম্পত্য ধষর্ণকে অপরাধের
অন্তর্ভুক্ত করা এই দেশগুলোর বেশিরভাগই ধর্ষক স্বামীর
জন্য সামান্যই শাস্তির বিধান রেখেছে।
মালয়েশিয়াতে যেখানে ধর্ষণের জন্য প্রচলিত
শাস্তি সর্বোচ্চ ২০ বছর সেখানে দাম্পত্য ধর্ষণের জন্য
ধর্ষক স্বামীর সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে মাত্র ৫ বছরের
কারাদণ্ড। আর শাস্তির সর্বনিম্ন কোনও
সময়সীমা না থাকায় ধর্ষক স্বামী এমনকি ন্যূনতম একদিন
পর্যন্ত শাস্তি পেতে পারে। কাছের দেশ নেপালে দাম্পত্য
ধর্ষণের শাস্তি প্রতীকী মাত্র – তিন থেকে ছয় মাসের
কারাবাস।
অথচ ‘আরএআইএনএন‘ এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নারীর
মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর দাম্পত্য ধর্ষণের
ভয়াবহ প্রভাবের চিত্র। ধর্ষণ মানেই বিভীষিকা, অপরিচিত
ব্যক্তির মাধ্যমে একবার ধর্ষণের শিকার হলে নারী সমগ্র
জীবন বয়ে বেড়ায় ওই দুঃসহ স্মৃতি; আর দাম্পত্য ধর্ষণের
ক্ষেত্রে নারীকে বছরের পর বছর বসবাস করতে হয় ওই
ধর্ষকের সঙ্গে। তাই সাধারণ ধর্ষণ যেখানে একবারের ঘটনা,
ম্যারিটাল রেপ হতে পারে নিত্যদিন বা বহুবার। লোকলজ্জায়
বা স্বামীর ভয়ে ধর্ষণের শিকার
নারী অনেকক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছেও যায়
না; ফলস্বরূপ দীঘর্দিন বয়ে বেড়ায় জটিল কোন যৌন রোগ
বা ক্ষত। দেখা দিতে পারে অনিদ্রা, হতাশা মানসিক
অসুস্থতা এমনকি মানসিক ভারসাম্যহীনতাও। দাম্পত্য
ধর্ষণের শিকার নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের উপরই শুধু নয়,
ওই দম্পতির সন্তানদের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ইউএনএফপিএ- এর ২০০০ সালের এক রিপোর্ট
অনুসারে ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ বিবাহিত
মহিলাকে স্বামী ধর্ষণ করেছে। অন্যদিকে প্রতি পাঁচজনের
একজন ভারতীয় পুরুষ স্বীকার করেছে স্ত্রীকে ধর্ষণের
কথা (আইসিআরডাব্লিউ-২০১১)।
প্রশ্ন জাগতে পারে, বাংলাদেশে দাম্পত্য ধর্ষণ হয় কি?
আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে দাম্পত্য ধর্ষণ স্বীকৃত নয়।
আবার এ সংক্রান্ত কোনও রিপোর্ট বা সমীক্ষাও নেই
আমাদের হাতে। তবে জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি আর আর্থ-
সামাজিককাঠামো মিল থাকার কারণে ভারতের উপরোক্ত
সমীক্ষা যে আমাদের সমাজেরও প্রতিচ্ছবি- তা বুঝতে খুব
বেশি বেগ পেতে হয় না।
যৌনতা বিষয়টি এখন ও আমাদের সমাজে ট্যাবু বা অচ্ছুৎ
কোন বিষয়। যৌনতা আর অধিকার নিয়ে আমাদের
ধারণাগুলো তাই খুব অস্বচ্ছ। সুতরাং, কোনও
নারীকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনার
স্বামী কি আপনাকে ধর্ষণ করেন বা কখনও করেছেন? -
অনেকেই কিছুটা চিন্তায় পড়ে যাবেন। কারণ, সমাজ
আমাদেরর শেখায় নারী হল সাব-হিউম্যান বা ঊনমানুষ অর্থাৎ
মানুষ তথা পুরুষ থেকে কিছু কম, নারী হলো তার স্বামীর
সম্পত্তি।
বাংলাদেশে দাম্পত্য ধর্ষণ হয় কিনা তার সঠিক তথ্য
জানতে হলে এ বিষয়ে সমীক্ষা আর গবেষণা প্রয়োজন।
সমীক্ষায় কোনও নারীকে নিম্নে বর্ণিত কিছু প্রশ্ন
করা যেতে পারে। যেমন:
১. আপনার স্বামী কি আপনি না বলা সত্ত্বেও তার
সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য আপনার ওপর বল
প্রয়োগ করে বা করেছে?
২. শারীরিক সম্পকের্র সময় কি আপনার
স্বামী অাপনাকে গুরুতর আহত করেছে?
৩. আপনার স্বামী কি কোনও প্রকার ভয় দেখিয়ে আপনার
সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে? এক্ষেত্রে আপনি কি ‘না‘
বলতে ভীত ছিলেন?
৪. আপনার স্বামী কি কখনও আপনাকে যৌন
হয়রানি করেছে এবং ওই হয়রানির কারণে আপনি কি তার
সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য হয়েছেন?
৫. আপনার স্বামীর কোনও যৌন আচরণে আপনি কি তীব্র
অস্বস্তিতে ভুগেছেন, তথাপিও তার সেই যৌন আচরণ
প্রতিপালন করেছেন বা করতে বাধ্য হয়ছেন?
প্রশ্নগুলোর যে কোনও একটির উত্তর হ্যাঁ-সূচক হলেই
এটি ম্যারিটাল রেপ বা দাম্পত্য ধর্ষণ।
মনে রাখা দরকার, দাম্পত্য ধর্ষণের ক্ষেত্রে যৌন সম্পর্ক
স্থাপনের জন্য আঘাত বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা বা আঘাত
করার হুমকি শুধু স্ত্রীর প্রতিই করা হয় না, অনেক সময়
পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের, যেমন: শিশুর প্রতিও
করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে পরিবারের ওই সদস্যের
নিরাপত্তার কথা ভেবে স্ত্রী বাধ্য হয় যৌন সম্পর্কে।
তাই, ম্যারিটাল রেপ বা দাম্পত্য ধর্ষণ একটি গুরুতর
অপরাধ। দাম্পত্য ধর্ষণকে অপরাধ
হিসাবে বিবেচনা করা এবং ধর্ষক স্বামীর কঠোর শাস্তির
ব্যবস্থা করা – এই ঘৃণ্য অপরাধ নিরসনে রাষ্ট্রের পদক্ষেপ
নেওয়া উচিত। সামাজিকভাবে নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই
দাম্পত্য ধর্ষণের
বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হতে পারে পরবর্তী কাযর্করি পদক্ষেপ।
ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) এবং মেট্রোপলিটন
পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের প্রদত্ত
সেবাগুলো সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা প্রয়োজন।
বর্তমানে মাত্র ছয়টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার
সহিংসতার শিকার নারীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নারীর
প্রতি ঘটে চলা সহিংসতার মাত্রা বিবেচনায় প্রয়োজন আরও
বেশি সংখ্যক ক্রাইসিস সেন্টার। ধর্ষণের শিকার নারীর
পুনর্বাসন এবং অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বি হওয়ার সুযোগ
সৃষ্টি করা গেলে দাম্পত্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার
হবে নারী। আর এভাবেই সম্ভব নারীর জন্য বৈষম্যহীন ও
নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা। তাই আজকের চাওয়া -গৃহ হোক
নারীর সবচাইতে নিরাপদ স্থান ।
লেখক: ব্যারিস্টার, সিনিয়র লেকচারার, নর্দার্ন
ইউনিভাসির্টি বাংলাদেশ

posted from Bloggeroid

No comments: