শরীফ সুমন, নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলায় গ্রেফতার র্যাবের
চাকরিচ্যুত সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদের মনোবল
ভেঙে পড়েছে। খুনে জড়িত সন্দেহে চাকরিচ্যুত অন্য দুই
কর্মকর্তা মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এমএম
রানা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক
জবাবনবন্দি দেয়ায় তারেকের মনোবল ভেঙে পড়ে।
এদিকে কাউন্সিলর নূর হোসেনের প্রধান বডিগার্ড
মোর্তুজা জামান চার্চিলকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ফরিদপুর সংবাদদাতা জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার
দিকে সদর উপজেলার নর্থ-চ্যানেল ইউনিয়নের দুর্গম
চরাঞ্চল থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
পরে তাকে নারায়ণগঞ্জ পুুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ভেঙে পড়েছে তারেকের মনোবল : নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের
মামলায় গ্রেফতারকৃত র্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত মেজর আরিফ
হোসেন ও ক্রাইম প্রিভেনশনাল স্পেশাল কোম্পানির
ইনচার্জ নৌবাহিনীর অবসরে পাঠানো লে. কমান্ডার এমএম
রানা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ায়
ভেঙে পড়েছে র্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত সিও লে. কর্নেল
তারেক সাঈদের মনোবল। ১৭ মে ভোরবেলায় গ্রেফতারের
পর তারেক সাঈদ দৃঢ় মনোভাব বজায় রাখলেও এখন
অনেকটাই নরম সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, বৃহস্পতিবার লে.
কমান্ডার এমএম রানা আদালতে ১৬৪ ধারায়
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর তারেকের মনোবল
আরও ভেঙে পড়েছে। কারণ দুজনের স্বীকারোক্তিতেই
নির্দেশদাতা হিসেবে তারেক সাঈদের নাম এসেছে।
বৃহস্পতিবার বিকালের পর থেকে তিনি আরও বিমর্ষ
হয়ে পড়েছেন। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করছেন না। তদন্ত
দল বিভিন্ন প্রশ্ন করলেও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
তারেক সাঈদকেও ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক
জবানবন্দি দেয়ানোর চেষ্টা করছেন তদন্ত তদারকরা।
এদিকে র্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত দুই কর্মকর্তার
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কিলিং মিশনে থাকা ২৩
সদস্যের মধ্যে বাকি ২০ জন
কারা তা নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। যাদের মধ্যে সামরিক
বাহিনীতে কর্মরত ২০ জন ও পুলিশ থেকে আসা তিনজন।
কিলিং মিশনের তিনজন এরই মধ্যে সাত খুনের মামলায়
গ্রেফতার হয়েছে। তবে বাকি ২০ জন এখনও
রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এছাড়া কিলিং মিশনের
নির্দেশদাতা র্যাবের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও
গডফাদাররাও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে তদন্ত
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যে কোনো সময় বাকিদের
গ্রেফতারে অভিযান শুরু হতে পারে। তবে এজন্য আইনের
বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এদিকে নাম প্রকাশ
করলে খুনিরা পালিয়ে যেতে পারে এ কারণে তদন্ত
সংশ্লিষ্টরা নাম প্রকাশ করেননি। নাম প্রকাশ না করলেও
নির্দেশদাতা ও গডফাদার কারা সে বিষয়টি এরই
মধ্যে অনেকে অনুধাবন করতে পেরেছেন। জেলার বিভিন্ন
স্থানে সাত খুনে র্যাবের সম্পৃক্ততা ও
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার
ঝড় বইছে।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন
জানান, সাত খুনের ঘটনায় জড়িতদের
গ্রেফতারে প্রতিটি বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। তদন্তের
স্বার্থে যে কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
অপকর্মে সিদ্ধহস্ত চার্চিল : মোর্তুজা জামান চার্চিল ছিল
নূর হোসেনের ডান হাত। নূর হোসেনের
নামে নেয়া লাইসেন্সকৃত (পরে বাতিলকৃত) পয়েন্ট ২২ বোরের
রাইফেল ও পিস্তল নিয়ে ছিল চার্চিলের অবাধ বিচরণ। বিশাল
গাড়িবহরে সবসময়ই চার্চিলের উপস্থিতি থাকত। নির্দেশ
পালনে বিন্দুমাত্র সময় নিত
না এবং টর্চারে পারদর্শী বলে চার্চিল ছিল নূর হোসেনের
প্রিয়দের একজন। নূর হোসেনের
নির্দেশে যে কোনো অপকর্ম করতে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। নূর
হোসেন কারো ওপর চটলে তার টর্চারের ভার পড়ত
চার্চিলের ওপরই। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জের
গজারিয়াতে ইউপি চেয়ারম্যান কিলিং মিশনেও ছিল চার্চিল।
নূর হোসেনের সব অপকর্মের নীরব সাক্ষী চার্চিল ছিল
সিদ্ধিরগঞ্জের ত্রাস।
জানা গেছে, সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি কাউন্সিলর
নূর হোসেন ও এজাহারভুক্ত আসামিদের
সঙ্গে পালিয়ে গেছে নূর বাহিনীর সহযোগী সন্ত্রাসীরাও।
যারা একসময় নূর হোসেনের বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র
নিয়ে দাবড়ে বেড়াত, পরিবহন, ফুটপাত, বালুমহাল, শিল্প
প্রতিষ্ঠানে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি,
ভূমিদস্যুতাসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়াত তারা এখন
ফেরারি। বিগত সময়ে নূর হোসেন যেখানে যেত সেখানে তার
বিশ্বস্ত সহযোগী আবুল কালাম ওরফে হিটলার কালাম,
কিলার সেলিম, ফরহাদ দেওয়ান, লোকমান মেম্বার, আরিফুল
হক হাসান, টোকাই শাহজাহান, সানাউল্লাহ সানা,
আলী মোহাম্মদ, জামাল উদ্দিন জামাল ছাড়াও ১৫ থেকে ২০
গাড়িবহরে থাকত বেতনভুক্ত সন্ত্রাসী বাহিনী। আর এ
সন্ত্রাসীদের মধ্যে মোর্তুজা জামান চার্চিল ছিল অন্যতম
সেনাপতি। এ বাহিনীর নেতৃত্ব দিত সে। এছাড়া নূর বাহিনীর
বডিগার্ডদের মধ্যে অন্যতম ছিল মহিবুল্লাহ (গ্রেফতারকৃত),
রিয়াদ, বাশার, জিতু।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মোর্তুজা জামান চার্চিল একসময়
সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরি করত। এ কারণে সে ছিল অস্ত্র
চালনা ও টর্চারে পারঙ্গম। নূর হোসেন কারও ওপর ক্ষুব্ধ
হলে টর্চারের জন্য চার্চিলকে নির্দেশ দিত। এছাড়া অনেক
কিলিং মিশনেও চার্চিল অংশ নিত। ফেব্রুয়ারিতে প্যানেল
মেয়র নজরুলের সঙ্গে সড়ক প্রশস্তকরণ কাজের দ্বন্দ্ব
নিয়ে নূর হোসেন বাহিনীর সংঘর্ষের সময় অস্ত্রের বহর
নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল এই চার্চিল। ওই সময়
চার্চিলকে অস্ত্র নিয়ে অনেকেই মহড়া দিতে দেখেছে।
সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ
নির্বাচনে ইউপি চেয়ারম্যান কিলিং মিশনেও ছিল চার্চিল।
সে ছিল শিমরাইল এলাকার ত্রাস। নূর হোসেন
যে গাড়িতে চড়ত চার্চিলও একই গাড়িতে অস্ত্র নিয়ে থাকত।
তার সঙ্গে বৈধ-অবৈধ সব ধরনের অস্ত্রই থাকত। নূর
হোসেনের লাইসেন্স বাতিল করা দুটি অস্ত্র (পয়েন্ট ২২
বোর রাইফেল ও এনপিবি পিস্তল তার কাছেই থাকত। নূর
হোসেনের বাড়ি ও এবিএস পরিবহন থেকে অন্তত
পাঁচটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হলেও তার লাইসেন্স
বাতিলকৃত অস্ত্র দুটি এখনও উদ্ধার হয়নি। স্থানীয়দের
অভিমত, ওই দুটি অস্ত্রের হদিস চার্চিল
জেনে থাকতে পারে।
এছাড়া চার্চিলকে রিমান্ডে নেয়া হলে অনেক চাঞ্চল্যকর
তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন
জানান, ফরিদপুর থেকে গ্রেফতারকৃত
চার্চিলকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে আসা হচ্ছে।
নূরের চাঁদার উৎসস্থল গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ :
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার প্রধান
আসামি কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তার ভাতিজা কাউন্সিলর
শাহজালাল বাদল নিয়ন্ত্রিত চাঁদার উৎসস্থল
গুঁড়িয়ে দিয়েছে জেলার পুলিশ প্রশাসন। এর অংশ
হিসেবে নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে চার দিন
একটানা উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে দুই শতাধিক অবৈধ
স্থাপনা ও খাবার হোটেল উচ্ছেদ করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক
(ডিআইও-১) মঈনুর রহমান জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-
সিলেট মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ে দুই
পাশের ফুটপাতে অবৈধভাবে নির্মিত শতাধিক পরিবহন
কাউন্টার, সিটি করপোরেশনের একটি যাত্রী ছাউনি, ২০
থেকে ২২টি খাবার হোটেল, দুই শতাধিক ভাসমান দোকানপাট
ও শতাধিক ফলের দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করত
নূর হোসেন ও তার বাহিনী। পুলিশ সুপারের নির্দেশে চার
দিনের অভিযানে ওইসব অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
এতে নেতৃত্ব দেন জেলা ট্রাফিক পুলিশের এএসপি বশির
আহমেদ। উল্লেখ্য, শিমরাইল মোড়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ
দুই বছর আগে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে রিকশা লেন নির্মাণ
করলেও ক্ষমতার দাপটে নূর হোসেন ও তার
ভাতিজা শাহজালাল বাদল তা দখল করে দৈনিক ও মাসিক
ভিত্তিতে চাঁদা উত্তোলন করত। শতাধিক বাস কাউন্টার
থেকে দৈনিক ৩০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হতো।
ছিন্নমূল হকার্স সমিতির সভাপতি পরিচয়দানকারী সেলিম
রেজা ফুটপাত থেকে চাঁদা তুলত।
সাখাওয়াতকে হুমকি : নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের
ঘটনায় র্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত তিন
কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের জন্য হাইকোর্টে রিট
দায়েরকারী ও আইনজীবীদের চলমান আন্দোলনে সোচ্চার
ভূমিকা রাখা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট
সাখাওয়াত হোসেন খানকে আবারও প্রাণনাশের
হুমকি দেয়া হয়েছে। সাখাওয়াত সাংবাদিকদের জানান,
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ আদালত
প্রাঙ্গণে তাকে অজ্ঞাত পরিচয় তিন থেকে চারজন
ডেকে নিয়ে হুমকি দেয়। হুমকিদাতারা তাকে র্যাবের
বিরুদ্ধে বেশি কথা না বলার এবং বেশি বাড়াবাড়ি না করার
জন্যও শাসায়। হুমকিস্বরূপ তাকে বলা হয়েছে,
আপনি র্যাবের বিষয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। এরকম
করলে পরিণতি ভয়াবহ হবে, গুম হয়ে যাবেন। তাই এ
নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। পরে সাখাওয়াত
বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করেন। ফতুল্লা মডেল থানার
ওসি আসাদুজ্জামান বলেন, এ ধরনের একটি বিষয়
অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান তাকে জানিয়েছেন।
তিনি তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন।
Posted via BN24Hour
No comments:
Post a Comment