মুসা ইব্রাহিমের বাংলা চ্যানেল জয় নিয়ে ৭১-এর
রিপোর্টিং ''বাংলা চ্যানেল পাড়িতেও মুসার
জালিয়াতি'' প্রচারিত হবার পর
মুসা ইব্রাহিম কে নিয়ে নতুন করে সমালোচনার ঝড়
উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এক্স-
নটরডেমিয়ান ও বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট
জয়ী মুসা ইব্রাহিম বিনয়ের সাথে সবকিছুর জবাব
দেন তার নিজস্ব ফেসবুক প্রফাইলে।বিডি২৪লাইভ
ডট কম পাঠকদের জন্য
স্টাটাসটি তুলে ধরা হলো এবং মে এর ১৫
তারিখে তারই লেখা "সাঁতরে বাংলা চ্যানেল ::
২০১১" লেখাটিও হুবুহু প্রকাশ করা হলো।
আমি আপনাদের মতামতকে সম্মান করি,
আপনাদের ভালো লাগা বা খারাপ লাগাকে সম্মান
করি।
২০১১ সালের বাংলা চ্যানেল সাঁতারে যদি প্রাণ
হারাতাম, আর তাতেই যদি কেউ ভালো বোধ করেন,
সেই বোধটাকেও সম্মান করি।
আমি কখনোই বলি নি যে, আমি পূর্ণাঙ্গ একজন
সাঁতারু। তাই সাঁতারু না হয়েও কাজী হামিদুল হকের
নেতৃত্বে স্নোরকেল সুইমিংয়ে অংশ নিয়েছিলাম
২০১১ এবং ২০১২ সালের বাংলা চ্যানেল সাঁতারে।
২০১২ সালের বাংলা চ্যানেল সাঁতারে কাজী হামিদুল
হক, লিপটন সরকার এবং আমাদের আমন্ত্রণে ডাচ
ইংলিশ চ্যানেল সুইমার ভ্যান গুল মিলকো'র
অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে টেকনাফের ফিসারিজ
জেটি থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ জেটি পর্যন্ত ১০
মাইল সাঁতারের পর বাংলাদেশের নাম
এবং ইন্টারন্যাশনাল লং ডিসটেন্স সুইমিং লিস্ট-এ
অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আপনাদের যদি এটাও ভালো না লাগে, সেটাকেও
সম্মান করি।
সর্বোপরি, ২০১১ সালের বাংলা চ্যানেল সাঁতারের
সব কথা লিখে রেখেছি বহু আগেই, বইয়ে,
ফেসবুকে ।
যদি মনে করেন কোনো অসত্য কথা বলেছি,
তাহলে আপনাদের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিব।
সাঁতরে বাংলা চ্যানেল :: ২০১১
২০০৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর থেকে নিজেই
নৌকা বানিয়ে সদরঘাট থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ
পর্যন্ত পাড়ি দেয়ার পর কাজী হামিদুল হকের
চিন্তায় টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত
সাঁতরে পাড়ি দেয়ার পরিকল্পনা খেলে যায়। সেটাই
যখন তিনি সবার সঙ্গে ভাগ করে নিলেন, তার সেই
স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন
লিপটন সরকার, ফজলুল কবির সিনা ও সালমান
সাঈদ। ২০০৬ সালেই তারা স্নোরকল সাঁতারের
মাধ্যমে টেকনাফের বদর মোকাম থেকে সেন্ট
মার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত সাঁতরে পার
হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরই
মাথায় ঘুরতে থাকে এই অ্যাডভেঞ্চারে নিজের
সামর্থকে পরখ করে দেখার চিন্তা। সেভাবে ২০০৯
সাল থেকে এই সাঁতারে অংশ নিচ্ছি-নিব
করতে করতে তা আর করা হয়ে ওঠে নি। আর
২০১০ সালে এভারেস্ট অভিযান নিয়ে বেশি মগ্ন
থাকায় ২০১০ সালেও বাংলা চ্যানেল সাঁতারে অংশ
নেয়া হয় নি।
কিন্তু ২০১১ সালটা সেই স্বপ্নপূরণের জন্য ছিল
মোক্ষম সময়। সে উদ্দেশ্যে সেভেন সামিট
অভিযানটা চিন্তায় পাকাপোক্তভাবে আসন
করে নেয়ার আগেই ফেব্রুয়ারি মাসে অনুশীলন
করে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেয়ার চেষ্টায়
নেমে পড়লাম। বাংলাদেশের ভূখন্ডের সর্বশেষ
স্থান টেকনাফের বদর মোকাম থেকে সেন্টমার্টিন
পর্যন্ত সাড়ে ১৪ কিলোমিটার সমুদ্রপথের নাম
দেয়া হয়েছে বাংলা চ্যানেল। গত ২০০৬ সাল
থেকে এই বাংলা চ্যানেলে সাঁতার আয়োজনের
পুরোধা কাজী হামিদুল হকের
তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদর দপ্তরের
সুইমিং পুলে অনুশীলন চলল স্নোরকল সুইমিংয়ের।
দিনটি ছিল ৯ মার্চ, ২০১১। সেন্ট মার্টিন
দ্বীপে ভোর আর ক’টা দিনের মতোই শুরু হয়েছিল।
মূল জেটির সৈকতের পাশে দাঁড়ালে যেন বিশাল এক
গ্যালারি। সেই গ্যালারিতে সমুদ্রের কোমল ঢেউ
পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে।
সেখানে দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের পাহাড় ভেদ
করা সূর্যোদয় উপভোগ করা যায়। সূর্যের
স্বর্ণাভা তখন সমুদ্রের পানিকে কাঁচা সোনায়
পরিণত করছে যেন। যেদিকেই চোখ যায় লাল
টকটকে সূর্য আর তার লালাভ রশ্মিই তখন
একমাত্র আকর্ষণ। সেই সূর্য একসময় রঙ
হারিয়ে টুক করে মাথার ওপর এসে পড়তে চায়।
আর সমুদ্রগামী ‘জালুয়া নৌকা’র কান্ডারি ব্যস্ত
হাতে বৈঠা চালান, দিনের প্রথমভাগেই কিছু
সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য। সৈকতের বিভিন্ন
পেশার মানুষ, কিছু পর্যটক ভোরের ঘুমকে বিদায়
দিয়ে তাদের কাজে নেমে পড়েছেন।
ধীরে ধীরে জেগে উঠছে দ্বীপ। এভাবেই সকাল
হলো ক্যাম্পে।
এদিন টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত
বাংলা চ্যানেলের সাড়ে ১৪ কিলোমিটার সমুদ্রপথ
সাঁতরে পাড়ি দিতে প্রস্তুত ফজলুল কবির সিনা,
লিপটন সরকার এবং আমি। সাপোর্ট
টিমে স্যাটেলাইট নেভিগেটর, সাঁতারের সময় পানি,
মধু, স্যালাইন ইত্যাদি এগিয়ে দেয়ার সহকারী,
স্থির ও চলমান চিত্রগ্রাহক ইত্যাদি সবাই
পারিবারিক সদস্যদের মতোই তৎপর। বরাবরের
মতো কোচের ভূমিকায় আছেন কাজী হামিদুল হক।
সিনা এর আগে দু’বার এবং লিপটন পাঁচবার
বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন। সুতরাং তাদের
অভিজ্ঞতায় ঘাটতি নেই। কিন্তু আমি এবারই
প্রথম। ঝুলিতে রয়েছে এভারেস্ট জয়ের
অভিজ্ঞতা। কিন্তু সেটা এক ভিন্ন জগত।
সমুদ্রপাড়ি দেয়া আরেক ঘরানার বিষয়। তবুও
সাহসে বুক বেধেছি যে বাংলা চ্যানেল
পাড়ি দেয়া অসম্ভব কোনো কাজ নয়।
২০১০ সালের এভারেস্ট অভিযানে নিজেই
নিজেকে সবসময় একটা কথা বলতাম। উচ্চতাজনিত
অক্সিজেনের ঘাটতি, আবহাওয়ার চোখরাঙানি আর
প্রকটতর ঠান্ডা - এসবকে ছাপিয়ে এই এপ্রিল-
মে মৌসুমে একজন পর্বতারোহীও
যদি সফলভাবে এভারেস্টচূড়ায় তার দেশের
পতাকা ওড়াতে পারেন, তাহলে সে কাজটি আমিও
পারবো। প্রচন্ড মানসিক চাপ সামলে অদম্য
মনোবল আর নিখুঁত টিমওয়ার্কের মাধ্যমে সেই
অভিযানে সফল হয়েছিলাম ২৩ মে।
এই জিদটাই বাংলা চ্যানেল জয়ের কঠিন লক্ষ্য
নির্ধারণে ঠেলে দিয়েছিল। লিপটন সরকার আর
ফজলুল কবির সিনা পারলে বাংলা চ্যানেল আমিও
সাঁতরে পাড়ি দিতে পারবো - নিজের মনকে ফের
একই কথা বলা শুরু করেছিলাম। ঢাকায় বাংলাদেশ
নৌবাহিনীর সুইমিং পুলে ফিন, স্নোরকল মাস্ক
ইত্যাদি সহকারে বিরামহীন দু’ঘণ্টা সাঁতার
কেঁটে এক প্রস্থ অনুশীলন হয়েছিল। আর সমুদ্রের
পানির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের
জেটি থেকে ছেঁড়া দ্বীপ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫
কিলোমিটার সাঁতরে আরেক দফা অনুশীলন করা হল।
৮ মার্চ সেই অনুশীলনের সময় দেখি চোখের
সামনে সমুদ্রের পাথরের ফাঁকে শত শত নাম
না জানা রঙিন মাছ। কিছু কিছু মাছ আবার
কাছে এসে পরখ করতে চায় যে এমন অদ্ভুত
আগন্তুক এলো কোথা থেকে! হঠাৎ দেখি রূপচাঁদার
মতো একটা মাছ। কিন্তু তার পিঠে প্রায় এক ফুট
লম্বা একটা দাঁড়ি এবং মাছটির পুরো শরীর সবুজ,
নীল, লালসহ বিভিন্ন রঙে সাজানো। অদ্ভুত! যেন
এক জীবন্ত অ্যাকুরিয়ামের মধ্য দিয়ে অনুশীলন
চলছে।কিন্তু সেদিন ছেঁড়া দ্বীপ পৌঁছার ঠিক এক
কিলোমিটার আগে হঠাৎ পায়ে ‘মাসল পুল’ করল।
তীব্র ব্যথায় যখন আর সাঁতরাতে পারছিলাম না,
মনে হচ্ছিল ডুবে যাচ্ছি। এ সময়
কোনোমতে নিজেকে ভাসিয়ে রেখে পানির মধ্যেই
হাত দিয়ে পায়ের আঙ্গুল টেনে ধরলাম যাতে পায়ের
পেশীতে একটু ঢিল পড়ে। এভাবে খানিকটা সময়
কাটিয়ে ফের সাঁতরে যেতে শুরু করলাম
ছেঁড়া দ্বীপের দিকে। আবার মাসল পুল করে,
আবারও
থেমে শরীরকে কোনোমতে ভাসিয়ে রেখে হাত
দিয়ে পা টেনে পেশীকে সহজ করার চেষ্টা চলে।
এভাবেই ছেঁড়া দ্বীপ পৌঁছে সেদিনের
মতো অনুশীলনে ইতি টানা হলো।
এতোটুকু অভিজ্ঞতা নিয়েই ৯ই মার্চ সকাল ন’টার
দিকে ট্রলারে করে সবাই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ
থেকে রওয়ানা দিলাম টেকনাফের শেষ স্থলভাগ
বদর মোকামের দিকে। যাত্রা শুরুর আগে হোটেলের
ক্যাম্পসাইটে সবাইকে নিয়ে টিমমিটিং সারা হলো।
টিমলিডার হিসাবে সবাইকে বুঝিয়ে দিলাম যার যার
দায়িত্বের কথা। কামাল আনোয়ার বাবু থাকবেন
ফজলুল কবির সিনা জন্য নির্ধারিত নৌকায়।
তিনি তাকে প্রয়োজনীয় সাধারণ বা ডাবের পানি,
মধু ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করবেন। লিপটন
সরকারের দায়িত্বে থাকবেন তার এক ভাগ্নে।
আমার জন্য নির্ধারিত নৌকায় থাকবেন ছন্দ ও
আরমান হোসেন দুলু। সাঁতারুদের পথ প্রদর্শনের
জন্য সবার আগে থাকা নৌকায় দায়িত্বে থাকবেন
রনি। তবে এই আয়োজনের সার্বিক
দায়িত্বে থাকবেন কাজী হামিদুল হক। সবাই যেন
তার যেকোনো আদেশ মেনে চলেন,
এটা অনুপুক্সক্ষ বুঝিয়ে দিলাম। বললাম যে, আজ
ফজলুল কবির সিনা, লিপটন সরকার
এবং আমি পানিতে নেমে সাঁতরাচ্ছি ঠিকই। কিন্তু
যারা নৌকায় থাকবেন, তারাও এই সাঁতারের
অপরিহার্য অংশ। সাঁতারুরা সফল
হওয়া মানে সেটা সাপোর্ট টিম মেম্বারদেরও
সাফল্য। সুতরাং সবাই একটা হাতের অবিচ্ছেদ্য
আঙ্গুলের মতো কাজ করে যাবো -
যেখানে যেকোনো একটা আঙ্গুল ছাড়া একটা হাত
অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়। মোট
কথা ‘টিমওয়ার্ক’টা সবচেয়ে বেশি জরুরি এমন
কঠিন একটা স্পোর্টে। কারণ অন্যান্য
স্পোর্টে পায়ের নিচে যখন মাটি থাকে, তখন এক
ধরনের ভরসা কাজ করে মনে। কিন্তু এমন
লং ডিসটেন্স সাঁতারে সেই ভরসা যায় উবে।
সুতরাং বাংলা চ্যানেল
সাঁতারে সবচেয়ে জরুরি হলো চরম মনোবল
এবং টিমওয়ার্ক।
এ সময় এটাও জেনে নিলাম
যে কারো কোনো প্রশ্ন বা সন্দেহ রয়েছে কি না।
সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। এ সময়
ফটোসেশন করা হলো। সাঁতারুরা সাঁতারের নির্দিষ্ট
পোশাকে আর সাপোর্ট টিম তাদের নির্দিষ্ট
পোশাকে। সাপোর্ট টিমের পোশাক
তৈরি করে দিয়েছেন ফ্যাশন হাউস নিত্য উপহারের
স্বত্ত্বাধিকারী বাহার রহমান।এবার ফটোগ্রাফি ও
ভিডিওগ্রাফি করার পুরো টিম, নর্থ আলপাইন
ক্লাব বাংলাদেশের সহসভাপতি পল্লব মোহাইমেন,
সাপোর্ট টিমসহ শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের
শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব আহসান খান,
বাহার রহমান, যুগান্তরের সাংবাদিক ও বন্ধু
আশিফ এন্তাজ রবি, প্রথম আলোর সাংবাদিক ও
বন্ধু সিমু নাসের, লিপটন সরকারের
সহধর্মিনী এবং কাজী হামিদুল হকের
সহধর্মিনীকে নিয়ে সবাই যেই না সেন্ট মার্টিন
দ্বীপের জেটিতে হাজির হয়েছি,
দেখি পুরো বাংলাদেশ নৌবাহিনী যেন আমাদের
সহায়তা করতে হাজির হয়েছেন।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল
জহির উদ্দীন আহমেদ, (এনডি), এনডিসি,
পিএসসি’র প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে এলো।
আমার দুলাভাই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর
অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার রাশিদুল হাসান-
এর মাধ্যমে ঢাকায় নৌবাহিনী প্রধানের
সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করেছিলাম যে ২০১১
সালের বাংলা চ্যানেল
সাঁতারে যদি তারা সহায়তা করেন,
তাহলে আমি চিরজীবন তাদের কাছে কৃতজ্ঞ
থাকবো। তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুরোধ
রক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কমান্ডার
মুশতাক আহমেদ (জি) পিএসসিসহ তার
বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।তার
ফলশ্রুতিতে খুলনা থেকে একটা নৌবাহিনীর জাহাজ
‘করোতোয়া’ এসে আগের রাতেই সেন্ট মার্টিন
দ্বীপের অদূরে নোঙর করেছে। সেই জাহাজের
কমান্ডিং অফিসার সিপিএসসিবিএন কমান্ডার এম
মাসুদ ইকবাল, লেফটেন্যান্ট কমোডর সায়ীদ,
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মইন, লেফটেন্যান্ট
আসিফ, ডুবুরি ও বাংলাদেশ নৌবাহিনী জাহাজ
পদ্মার এক্সিকিউটিভ অফিসার লেফটেন্যান্ট
ফয়জুল ইসলাম মন্ডল, সেন্ট মার্টিন
দ্বীপে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পিও জসিম
এবং জনাব ফেরদৌসসহ আরও অনেক ডুবুরি,
নৌসদস্যের এক বিশাল বহর
জেটিতে অপেক্ষা করছেন। তারাও সাঁতারুদের জন্য
নৌকা সংগ্রহ করেছেন। ফলে বিশাল
একটা নৌকাবহর হয়ে গেল। যেন যুদ্ধের
একটা সাজ সাজ রব। এছাড়াও নৌবাহিনীর
একটা জেমিনি বোট তো রয়েছেই।
সকাল সাড়ে ন’টার দিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এই
চৌকষ সাঁতারু ও ডুবুরির দল, তাদের রাবারের
জেমিনি স্পিডবোট, কোস্টগার্ড-এর কর্মকর্তা,
আমাদের ভাড়া করা ট্রলার, সাধারণ
নৌকা ইত্যাদির এক বিশাল বহর চলল অভিযানে।
তবে গতকালের তুলনায় ঢেউ আজ অনেক বেশি।
ট্রলারের সামনের আর পেছনের দিক বারবারই
আকাশমুখী হচ্ছে, এতো বড় বড় ঢেউ। এর ভেতর
দিয়েই সাঁতরে পার হতে হবে? এটা ভাবতেই যেন
মন দমে যায়। কিন্তু মনকে সাহস
যোগাতে থাকি যে এরকম পরিস্থিতির মধ্য
দিয়ে লিপটন আর সিনাও নিশ্চয়ই সাঁতার কাটবেন।
আর তারা পারলে আমিও পারবো।জোয়ার-ভাটার
হিসাব করে দেখা গেল আমরা যদি বেলা বারটার
দিকে সাঁতরে সেন্টমার্টিন দ্বীপের
দিকে রওয়ানা দেই, তাহলে ভাটার টানে সাঁতার
কাটা সহজ হবে। সে অনুযায়ী সমুদ্রে নামতে নামার
প্রস্তুতি নিচ্ছি। যতই সময় ঘনিয়ে আসছে, ততোই
যেন বাতাসের তীব্রতাও বেড়ে গেল সেই ভর
দুপুরে। সে সময়ে বাতাসের
সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢেউয়ের পাগলামিও যেন তুঙ্গে।
আমরা সাঁতরাবো উত্তর থেকে দক্ষিণে। কিন্তু
বাতাস বইছে পশ্চিম থেকে পূব দিকে। অর্থাৎ
সাঁতারের গতিপথ বাতাস ও স্রোতের পুরোই
আড়াআড়ি। ট্রলার আর নৌকার
মাঝিকে বলে দিলাম সাঁতারুদের বাম
দিকে থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের
দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। নাহলে তা বাতাসের
ধাক্কায় সাঁতারুদের গায়ের ওপর চলে আসতে পারে।
এরই মধ্যে টেকনাফ পুলিশ ফাঁড়ি থেকে পুলিশ
সদস্য, টেকনাফের কয়েকজন সাংবাদিক ফুল
নিয়ে হাজির শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। আর
বেসরকারি টিভি চ্যানেল এটিএন বাংলার সাংবাদিক
রেদোয়ান ঢাকা থেকে এসেছেন এই সাঁতারের খবর
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকেই প্রচারের জন্য।
তিনি তার ক্যামেরাম্যান ও
সহযোগী নিয়ে প্রস্তুত।
এবার মাহবুব স্যার, রবি, সিমু ও
কিমি ফিরে চললেন ঢাকার পানে। তারা সেই
ঢাকা থেকে এক রাতের জন্য সেন্ট মার্টিন
দ্বীপে এসেছিলেন শুভকামনা জানাতে। সাঁতারের
পোশাক পরে এক দফা ফটোসেশন করা হলো।
এরপর সমুদ্র-সাঁতারের পোশাক, স্নোরকল, মাস্ক
ইত্যাদিপরে নিয়েসমুদ্রেনামতে নামতে সোয়াবারটা।
কিন্তু এমন ঢেউ যে সাগরে নামাই যেন দায়।
এরপর কোনোমতে নামতেই পানির মধ্যে পথ
ভুলে ফের পাড়ের দিকে যেই না সাঁতরে গেছি,
নৌকা, ট্রলার আর স্পিডবোটে থাকা সবাই হই হই
করে পথের নিশান ঠিক করে দিলেন।
এভাবে ঘণ্টাখানেক সাঁতার কাটার পর নাফ
নদী আর সমুদ্রের মিলনের ফলে সৃষ্ট
ঘোলাটে পানির অংশ পার হয়ে এলাম। এরপরই
ঢেউয়ের পাগলামি বেড়ে গেল বহুগুণ।
একবার ঢেউয়ের মাথায় গিয়ে উঠি তো আরেকবার
মাথার ওপর দিয়ে ঢেউ চলে গিয়ে পানির নিচে।
স্নোরকল পাইপ দিয়ে সমুদ্রের তীব্র লবণাক্ত
পানি মুখের ভেতর চলে আসে। একেবারে টালমাটাল
অবস্থা। মনোবল হারাতে শুরু করলাম।
বাকি অংশটুকু সাঁতরে যেতে পারবো কি না, সেই
আত্মবিশ্বাস যেন ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছে।
আমার মনের অবস্থা হয়তো লিপটন সরকার
বুঝতে পারলেন। সাঁতরে কাছে এসে বললেন, এমন
ঢেউ থাকবেই। এটা কোনো সমস্যা নয়। কিছুক্ষণ
পর তাকে হারিয়ে ফেললাম। এ সময় মাথা তুলতেই
দেখি চারপাশে যেন ট্রলারের মেলা লেগেছে।
টেলিভিশনে ব্যক্তিগতভাবে অনুষ্ঠান
প্রস্তুতকারী এক ব্যক্তি একেবারে দশ হাত দূর
থেকে তার ট্রলার চালিয়ে চলে গেলেন। সেই
ঢেউয়ে মাথা চরকি দোলার মতো ঘুরছে। এরপর
মরার ওপর যেন খাড়ার ঘা। হঠাৎ
দেখি একটা ট্রলার নিয়মের তোয়াক্কা না করে ডান
দিকে চলে এসেছে। ঠিক যেই ভয়টা করছিলাম।
ইঞ্জিন বন্ধ থাকায় বাতাসের ধাক্কায়
ট্রলারটা একেবারে গায়ের ওপর এসে পড়ল।
এইইই! ট্রলারের তলায় ঢুকে যাচ্ছি-ই-ই-ই! এবার
মনে হয় মৃত্যু আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। এমন
সময় কোথা থেকে যেন দু’টো হাত
এসে টেনে তুলল ট্রলারের ওপর। জানতে পারলাম
পায়ের পেশীতে টান পড়ায় ফজলুল কবির
সিনা সাঁতার শেষ না করেই ট্রলারে উঠে পড়েছেন
এবং তাকে সুশ্রুষা করা হচ্ছে।
এবার মিনিট পাঁচেক সুস্থির হয়ে নির্দেশ দিলাম
সবগুলো ট্রলার যেন নিজ গন্তব্যে চলে যায়, শুধু
নৌবাহিনীর জেমিনি বোট থাকলেই চলবে। এমন
সময় নৌবাহিনীর ডুবুরিরা বলছিলেন, আর
না সাঁতরাতে। কারণ অজানা কারণে সমুদ্র আজ
ভয়ানক উত্তাল। প্রতিটা ঢেউ এরই মধ্য
সমুদ্রে ‘হোয়াইট হর্স’ বা সাদা ফেনা সৃষ্টির মধ্য
দিয়ে শেষ হচ্ছে। যা কোনো ভালো লক্ষণ নয়।
কিন্তু ভাবছিলাম এখানেই হেরে গেলে চলবে না।
একজনও যদি পারে আজ সাঁতার শেষ করতে,
সেটা আমিও পারবো। এমন চিন্তায় ফের
নেমে পড়লাম সমুদ্রে। এবার
একটানা সাঁতরে গেছি। পাশে ছিল শুধু
জেমিনি বোট। মাঝেমধ্যে শুধু কয়েকবার পাওয়ার
জেল, পানি, ডাবের পানি, স্যালাইন
ইত্যাদি খেয়েছি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ যেন বহু দূ-উ-
রে কালো বিন্দুর মতো তীর চোখে পড়ল। সাঁতার
থামিয়ে এ সময় নৌবাহিনীর ডুবুরিদের জিজ্ঞেস
করলাম সেটাই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কি না?
তারা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই মনোবল
বেড়ে গেল। তাহলে তো এসেই পড়েছি।
হয়তো আর খুব বেশি হলে ঘণ্টাখানেক সময়
লাগবে। এভাবে একটানা সাঁতরে চলেছি। সাঁতরাই
আর মাথা তুলে দেখি যে ঠিক পথে আছি কি না।
এর মধ্যে অবশ্য সেই পাগলপানা ঢেউ বন্ধ
হয়েছে। সমুদ্র অনেকটাই তখন শান্ত। হঠাৎ খেয়াল
করলাম ওই তো জেটি দেখা যায়। তার
অদূরে নৌবাহিনীর জাহাজ নোঙর করা আছে।
আমি মাথা ঘুরিয়ে জেটির দিকে সাঁতরাতে শুরু
করেছি ঠিকই। কিন্তু সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পূব
দিকের তীব্র স্রোত যেন আমাকে ছেঁড়া দ্বীপের
দিকে নিয়ে যেতে চাইছে।
এর পর সাঁতরাচ্ছি তো সাঁতরাচ্ছি। সমুদ্রপথ যেন
আর শেষ হয় না। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করে বুঝলাম
আমি একটা জায়গায় স্থির হয়ে সাঁতরাচ্ছি। অর্থাৎ
জেটির তীরের দিকে এক ফুট এগোচ্ছিও না,
পিছিয়েও যাচ্ছি না। আরও বুঝতে পারলাম এই
মুহূর্তে আমার সাঁতারের গতি আর পানির স্রোতের
বিপরীত গতি সমান। ফলে দু’টার সম্মিলিত
গতি আমাকে স্থির রেখেছে।
এভাবে আমি না কি প্রায় আধ ঘণ্টা সাঁতার
কেটেছি। এমন সময়
জেমিনি বোটে থাকা ডুবুরিরা বললেন, “মুসা,
আপনার কোচ কাজী হামিদুল হক বলেছেন
যে আপনি সাঁতারের নির্দিষ্ট দূরত্ব এরই
মধ্যে অতিক্রম করেছেন। ফলে আপনি যদি চান
তোতিনিআপনাকেজেমিনিবোটেকরেতীরেযেতেবলেছেন।”
শুনে আমি আর পানি থেকে মাথা তুলি না। শুধু
পানির ওপর হাত তুলে তাদের কথায়
অসম্মতি জানাই।
মনে মনে ভেবেছি, এতোটা দূর যদি সাঁতরাতে পারি,
তাহলে এই স্রোতও ডিঙিয়ে তীরে ভিড়তে পারবো।
এমন চিন্তাতেই জোরে জোরে হাত-
পা চালাতে লাগলাম।এমন সময় ঠান্ডা পানির
একটা স্রোত এসে ধাক্কা মারলো। সূর্যও সেন্ট
মার্টিন দ্বীপের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পশ্চিম
দিকে হেলে পড়েছে। ফলে শরীর যেন ক্রমেই
ঠান্ডা হয়ে যেতে শুরু করলো। শরীরকে গরম
রাখতেই এবার আরও জোরে হাত-পা চালিয়েছি।
এবার পানির
মধ্যে মোটা মোটা সাদা কণা গড়িয়ে যেতে দেখলাম।
মনে হচ্ছিল
যে পাড়ে চলে এসেছি এবং পা নামিয়ে দিলে মাটির
সাক্ষাত পাবো। কিন্তু সেটা ছিল ভুল ধারণা।
মাটিতে পা ঠেকে না। এবার আরও জোরো হাত
চালাচ্ছি। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজনের
আকার বড় হয়ে এলো। গাছপালাও অনেক বড় বড়।
তীরের কোলাহলও যেন কানে আসছে!
বুঝতে পারলাম তীর আর মাত্র কয়েক মিনিটের
দূরত্বে। এমন সময় জেমিনি বোট থেকে লাফ
দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ফয়জুল
ইসলাম মন্ডলসহ আরেকজন লাফ
দিয়ে পানিতে নেমে আমাকে গাইড করে তীরের
দিকে নিয়ে চললেন।
সাঁতরে যখন বুক সমান পানিতে এসে হাজির, এ
সময় মাটিতে দাঁড়িয়ে স্নোরকল মাস্ক
খুলে তা আকাশে ছুঁড়ে উল্লাস প্রকাশ করলাম।
এভাবে চার ঘণ্টা ৫৭ মিনিটে পৌঁছেছি যখন সেন্ট
মার্টিন দ্বীপে, সবাই আনন্দে মাতোয়ারা। লিপটন
সরকার তার সাঁতার শেষ করেছিলেন চার ঘণ্টায়।
সবাই কৃতজ্ঞতার
বন্ধনে জড়িয়ে আরেকটা চ্যালেঞ্জ জয়ে সেদিন
অগ্রগামী ছিলেন। পর্বতারোহণের
পাশাপাশি সাঁতারের
মতো অভিযানে আরেকটি মাইলফলক যুক্ত
হলো অর্জনের খাতায়।
Posted via Blogaway
No comments:
Post a Comment